সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি

1

শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণ আমাদের দেশের জন্য নিত্য ঘটনা। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় একটি অংশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন হওয়ায় বায়ুদূষণটা আরো বেড়ে যায়। পাশাপাশি অবকাঠামো, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ইটভাটা ইত্যাদির কারণে এ দুটি প্রধান শহরসহ অধিকাংশ বিভাগীয় শহরে বায়ুদূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। সম্প্রতি ঢাকার বায়ুদূষণ হ্রাসে অন্তর্বর্তী সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। আমরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এ জাতীয় উদ্যোগ চট্টগ্রাম শহরের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে। সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ ভবনে ‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক এক সভায় এ সমন্বিত পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা অনুযায়ী ২০ বছরের অধিক সময়ে পুরাতন জরাজীর্ণ বাসগুলো সড়ক থেকে প্রত্যাহার, রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিবন্ধনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড স্থানান্তর, ফুটপাত দখলমুক্ত, আশুলিয়াকে ‘নো ব্রিকফিল্ড’ করা, সড়ক বিভাজক ও অনাবৃত জায়গায় ঘাস রোপণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উক্ত সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং অংশীজন অংশ গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ বিগত দিনের সমন্বয়হীনতা এবং অব্যবস্থাপনার পর্বত অতিক্রম করে এই প্রথমবারের মত ঢাকার দূষণ হ্রাসকার্যে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে এক সূত্রে গাঁথা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স, যার পক্ষ হতে প্রতিটি সরকারি দপ্তরকে অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনে নির্দিষ্ট সময়সীমাও নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমনটি, আগামী এক মাসের মধ্যে সেবায় উন্নতি করতে না পারলে দেশের পরিবহন খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানসহ সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মে মাসের মধ্যে ২০ বৎসর বয়সী সকল বাস ঢাকার সড়ক হতে তুলে নিতে হবে। রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিবন্ধনের আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন কার্যক্রম এক সপ্তাহের মধ্যে শুরুর করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। ২০১৫ সালে প্রদত্ত আদালতের নির্দেশনার কার্যকর করতে এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানও চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। আমরা মনে করি, যদিও সিদ্ধান্তগুলো ঢাকাকে কেন্দ্র কওে নেয়া হয়েছে, তবুও আশা করা যায়, যেহেতু সকল মন্ত্রণালয় বসে এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই চট্টগ্রামসহ সারা দেশে এ সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
বলার অবকাশ রাখেনা যে, বায়ুদূষণ রাজধানী ঢাকার জনস্বাস্থ্যের জন্য বহু পূর্বেই ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে গিয়াছে। কিন্তু গত ছয়-সাত বছর যাবৎ এই বায়ুদূষণ বৈশ্বিক মানদন্ডে একেবারে শীর্ষে উঠে গেছে। বায়ুদূষণে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, যা আমাদেও জন্য গভীর উদ্বেগের। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঢাকা শহরের মানুষের নিকট নির্মল বায়ু এখন এক প্রকার আশীর্বাদের মত। তাদের বৎসরের অধিকাংশ সময় এক প্রকার বিষবাষ্পেই নিমজ্জিত থাকতে হয়। ২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশিত বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে দুই লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সা¤প্রতিক সময়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষত শিশুদের মধ্যে সর্দি-কাশির যেই প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এরও পশ্চাতে রয়োছে মাত্রাহীন বায়ুদূষণ। অন্যদিকে এই বায়ুদূষণের কারণসমূহ চিহ্নিত হলেও বিগত কয়েক দশক সেইগুলো দূর করতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় নি। এমনকি দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের একাধিক নির্দেশও দিনের পর দিন উপেক্ষিত হয়ে আছে। তবে সেই সময়ে যারা এই পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, তাদের অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিগত সরকারসমূহের আশীর্বাদধন্য বায়ুদূষণকারীদের এই সরকারের নিকট হতে উদার দৃষ্টিপ্রাপ্তির কোনো কারণ রয়েছে বলে আমরা মনে করি না। তাই এইবার রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরের অধিবাসীরা অন্তত দূষণ হ্রাস বিষয়ে আশাবাদী হতে পারে।
পরিবেশ উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন, বায়ুদূষণ হ্রাস এক-দুই মাস বা এক বছরের ব্যাপার নয়। চীনের ন্যায় দেশেরও দূষণ হ্রাসে ১০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু অন্তত সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিসমূহের কার্যকর প্রয়োগপূর্বক ধুলার যন্ত্রণা হ্রাস ও গাড়ির কালো ধোঁয়ামুক্ত ঢাকা নিশ্চিতকরণ, এরসাথে দূষণকারী ইটভাটা ও স্টিল মিল বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ দৃশ্যমান হলে বায়ুদূষণ বন্ধে নাগরিক উদ্যোগসমূহও যে উৎসাহিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। আমরা মনে করি, সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে তা চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী কার্যকর করতে পারলে বায়ুদূষণ থেকে দেশ ও দেশের মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।