সপ্তাহের শেষে আবারও ভারী বর্ষণের সতর্কতা

47

মৌসুমের প্রথম ভারী বর্ষণে বিস্তীর্ণ জনপদে বান ডেকে আনার পর শ্রাবণের শুরুতে খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল মৌসুমি বায়ু। গত ক’দিন ধরে তা দেশের ওপর কম সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে দুর্বল অবস্থায় বিরাজ করছে। তবে চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে দুর্বলতা কাটিয়ে ফের প্রবল অবস্থায় সক্রিয় হতে পারে। তাতে দ্বিতীয় দফায় দেশজুড়ে ভারী বর্ষণ দাপট দেখাতে পারে জানিয়ে প্রয়েঅজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
মৌসুমি বায়ুর সর্বশেষ অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক গতকাল রবিবার পূর্বদেশকে বলেন, ‘দেশের ওপর মৌসুমি বায়ু বর্তমানে কম সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে তা দুর্বল অবস্থায় বিরাজ করছে। তাই শ্রাবণের শুরুতে বর্ষণ-বিরতির যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা আগামী দুয়েকদিন অব্যাহত থাকবে। তবে, সপ্তাহের শেষদিকে তা প্রবল অবস্থায় সক্রিয় হওয়ার আলামত রয়েছে। এতে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। কোথাও কোথাও তা ভারী বর্ষণেও রূপ নিতে পারে।’
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে রবিবার সন্ধ্যা ছ’টার পর প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিক্ষিপ্তভাবে দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ ৮৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে সিলেটে। এছাড়া, শ্রীমঙ্গলে ২৫ ও তেঁতুলিয়ায় রেকর্ড করা হয় ৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। রাজশাহী ছাড়া বাকি সব বিভাগের দুয়েকটি এলাকায় সিঙ্গেল ডিজিটের বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ ভারতের রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল অতিক্রম করে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর কম সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে তা দুর্বল অবস্থায় বিরাজ করছে। শ্রাবণের শুরুতে দেশের ফরিদপুুর, মাইজদী কোর্ট বা নোয়াখালী, রাজশাহী, তাড়াশ, দিনাজপুর, খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। মৃদু তাপপ্রবাহের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়েছে মাইজদী কোর্টে। অধিদপ্তর রবিবার সন্ধ্যা ছ’টার পর থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য আবহাওয়ার যে পূর্বাভাস প্রচার করেছে তাতে বলা হয়, সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায়; রংপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম কিছু কিছু জায়গায় এবং রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে।
এর আগে গত ৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগে টানা ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল বিস্তীর্ণ জনপদে বান ডেকে আনে। আষাঢ়ের বিদায়ের দিনে গত সোমবার চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে বিরতি নিয়েছিল মৌসুমের প্রথম ভারী বর্ষণধারা। তাতেই আকাশে মেঘের আড়াল সরিয়ে দেখা মিলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের। সূর্যের দিনমান এই হাসি পরম আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয় বানভাসী মানুষের জীবনে। বর্ষণ-বিরতিতে বানের পানি ধীরে ধীরে নামতে থাকায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতিও উন্নতির দিকে পথচলা শুরু করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ভারী বর্ষণকবলিত বিগত দশদিনে শুধু চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে হাজার মিলিমিটার ছাড়িয়ে যাওয়া বৃষ্টিপাতের সাথে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নগরীতে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি কমবেশি ১৪ উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যায়। একইভাবে কক্সবাজারের চকরিয়াসহ তিন পার্বত্য জেলায়ও লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বানের পানির নিচে ডুবে যায় সড়ক-মহাসড়ক থেকে শুরু করে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। নদীর ভাঙনকবলিত এলাকার শতাধিক বাড়িঘর স্রোতে ভেসে গেছে। সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদা, ইছামতি, ডাবুয়া, সর্তা, ও শঙ্খ নদীর পানি এখনও প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছে। ভূমিধসে হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
এদিকে, রেকর্ড ছাড়ানো ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হলেও দেশে ‘ভয়াবহ বন্যা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বিগত ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ এর মতো বড় বন্যার আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, সাধারণত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার পানি একযোগে বাড়লেই দেশে বড় বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। আপাতত তিন অববাহিকায় একইসঙ্গে পানি বাড়ার কোনও আলামত দেখছেন না সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, বাংলাদেশের উজানে ভারতীয় অংশে আর দেশের অভ্যন্তরে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ যাত্রায় বন্যার ব্যাপ্তিকাল এক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে। আর জুলাই মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে অধিদপ্তর জানিয়েছিল, জুলাইয়ের মধ্য ও শেষভাগে মৌসুমী বায়ু দেশের ওপর প্রবলভাবে সক্রিয় হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়ে যেতে পারে। একই কারণে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম এবং মেঘালয়েও যদি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ে, তাতে পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হতে পারে। এজন্য মাসের শেষার্ধে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মধ্যমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলেও দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছিল।