নিজস্ব প্রতিবেদক
সন্দ্বীপে উপকূল রক্ষা প্রকল্প নিয়ে বেসামাল অবস্থায় পড়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। মূলত সন্দ্বীপের প্রকল্পে কাজ পাওয়া পাউবোর পছন্দের আওয়ামী লীগপন্থী ঠিকাদাররাই এখন ‘গলার কাঁটা’। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঠিকাদাররা গাঁ ঢাকা দেয়ায় উপকূল রক্ষায় বৃহৎ এই প্রকল্প থমকে গেছে। যে কারণে যথাসময়ে প্রকল্প কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত বছরের মার্চ মাসে কাজ শুরু হলেও এক বছরে মাত্র ৪ শতাংশ কাজের অগ্রগতি হয়েছে। সন্দ্বীপের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সন্দ্বীপের সন্তান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যখন সক্রিয় তখন পাউবোর প্রকল্পের এমন দুর্দশায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন দ্বীপবাসী।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ.ম জুলফিকার তারেক পূর্বদেশকে বলেন, ‘ঠিকাদাররা কাজ শুরু করেছে। তাদের অবস্থা একটু খারাপ হওয়ায় সমস্যা হয়েছে। সেখানে মালামাল নিতেও সমস্যা। বর্ষার শেষে নদীতে পানি বেশি থাকাবস্থায় আগস্ট-সেপ্টেম্বরেই মালামাল নিতে হয়। কিন্তু সেসময়ে অস্থিরতার কারনে ঠিকাদার মালামাল নিতে পারেনি। যে কারণে কাজ স্লো হয়েছে। তারা যথাসময়ে কাজ করবে বলে আমাদের জানিয়েছে’।
সন্দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, এক বছরে অল্পকিছু অংশে মাটি সরানো ছাড়া তেমন কোনো কাজ হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও নিয়মিত সন্দ্বীপে যান না। তারা চট্টগ্রাম শহরের অফিসে বসেই সন্দ্বীপের কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন। অথচ সরকারের ঊর্ধ্বতন কেউ আসলেই ঠিকই তারা হাজির হন। এমপি মিতার আস্থাভাজন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা শুরুর দিকে এই কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন প্রকল্প এলাকায় ঠিকাদারের কোনো লোককে দেখা যায় না। দ্রুত কাজ শুরুর জন্য স্থানীয়রা মানববন্ধন করলেও তাতেও কাজ হয়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে টেকসই এই বাঁধ নির্মাণ না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সন্দ্বীপ উপকূলীয় মানুষ। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এই দ্বীপের বাসিন্দারা।
সন্দ্বীপের মগধরা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘উপকূল রক্ষা প্রকল্প নামেই শুরু হয়েছে; কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শুনেছি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদারদের নোটিশ দিয়েছে। এই নোটিশ তারাতো মনে হয় গুরুত্ব দেয়নি। আওয়ামী লীগপন্থী ঠিকাদারদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে এই কাজ দিয়েছে পানি বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তার সাথে বিশ্বাস বিল্ডার্সের ঘনিষ্টতা থাকায় অতীতের প্রকল্পের কাজের অনিয়ম করেও দ্বিতীয়বার আবারও কাজ পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এই টেন্ডার প্রক্রিয়া দুদক তদন্ত করলেই থলের বিড়াল বের হবে’।
পাউবো সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলাস্থল পোল্ডার নং-৭২ এর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের স্থায়ী পুনর্বাসনসহ ঢাল সংরক্ষণ প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই একনেকে অনুমোদন হয়। একই বছরের নভেম্বরে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হলেও ভৌত কাজ শুরু হয় গত বছরের মার্চে। প্রকল্পের আওতায় ১২.৩৪ কিলোমিটার বাঁধ পুনরাকৃতি ও ঢাল সংরক্ষণ, সাতটি রেগুলেটর পুর্নবাসন, দু’টি রেগুলেটর নির্মাণ, একটি মনিটরিং ও স্টোর হাউজ নির্মাণ, ১.৫ কিলোমিটার ভ‚মি পুনরুদ্ধার রয়েছে। ১৭টি প্যাকেজে এ প্রকল্পের কাজ বিভক্ত করা হয়।
এরমধ্যে ২৬০ কোটি টাকার আটটি প্যাকেজ বিশ্বাস বিল্ডার্স, ১১২ কোটি টাকার চারটি প্যাকেজ ই-ইঞ্জিনিয়ার, ৮৬ কোটি টাকার তিনটি প্যাকেজ খুলনা শিপইয়ার্ড, ৫৬ কোটি টাকার দুটি প্যাকেজের কাজ পায় রয়েল এসোসিয়েট। বিশ^াস বিল্ডার্সের মালিক ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম। রয়েল এসোসিয়েটের মালিক পটিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও মহানগর যুবলীগ নেতা দিদারুল আলম। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে এই দুই ঠিকাদার আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় প্রকল্প কাজ থমকে যায়।
প্রকল্প কাজের বিষয়ে জানতে বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপক ফিরোজুর রহমানকে ফোন দেয়া হলেও পাওয়া যায়নি। তিনি এর আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বর্ষা মৌসুমের কারনে কাজ শুরু করা যায়নি। এখন কাজ শুরু করবে।
সন্দ্বীপ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সৈয়দ আরশাদ আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘সন্দ্বীপ প্রকল্পের চার শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এরমধ্যে আবার কাজ শুরু হয়েছে। কিছু ঠিকাদার মোবিলাইজেশন শুরু করেছে, কয়েকজন কাজ শুরু করেছে। বিশ্বাস বিল্ডার্স মালামাল আনছে এরপর কাজ শুরু করবে। কাজ বন্ধ রাখার কারনে ঠিকাদারদের তাগাদা পত্র দিয়েছি। বিশ্বাস বিল্ডার্স এ মাসের মধ্যে পুরোপুরি কাজ শুরু করবে বলেছে। দূর্গম এলাকা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে মালামাল আনা নেয়ায় সমস্যার কারনে কাজ স্লো হয়েছে’।
২০১৯ সালে সন্দ্বীপের ২০৫ কোটি টাকার প্রকল্পে প্রায় ১২৫ কোটি টাকার কাজ পেয়েছিল বিশ্বাস বিল্ডার্স। এই প্রতিষ্ঠানের করা তৎসময়ের কাজ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। ব্লক নির্মাণসহ সংস্কার কাজে অনিয়ম হওয়ায় সে প্রকল্পও স্থায়ী হয়নি। এমন বিতর্কের পরেও পুনরায় বিতর্কিত ঠিকাদারকে কাজ দেয়ার নেপথ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সিন্ডিকেট কাজ করেছে। যারা এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে মরিয়া ছিল।