সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

3

দেশের পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি কম হয়নি। সম্পাদকীয় স্তবকেও সড়কে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! মাঝেমধ্যে হাইওয়ে পুলিশের টহল জোরদার ও অভিযান চলানো হলেও তা একেবারে লোক দেখানো। বাস্তবে অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মত দল নিরপেক্ষ সরকারের আমলেও সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেড়ে গিয়েছে। চাঁদা না দিলে হামলা মামলার মত ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দেয়ার অভিযোগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের বিরতিহীন সার্ভিস ঈগলের কাউন্টারে হামলা করে একদল দুর্বৃত্ত। গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদে বলা হয়েছে, বুধবার দুপুরে শাহ-আমানত সেতু এলাকায় ঈগল এক্সপ্রেসের কাউন্টারে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে মালিক-শ্রমিকদের গুরুতর জখম করে। ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে গণ-পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নেতৃবৃন্দ এক প্রতিবাদ সভায় চট্টগ্রামে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে যেকোনো সময় গণপরিবহন বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এ সময় বক্তারা বলেন, একদল চাঁদাবাজ ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঈগল এক্সপ্রেসের কাউন্টারে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। এতে গণপরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা আহত হয়েছেন। এই ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই সন্ত্রাস-চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম। বন্ধ করা না হলে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্য গণ-পরিবহন সেক্টরে যেকোন সময় অচল অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। তখন পরিবহন মালিক শ্রমিকদের দায়ী করা যাবে না। শুধু চট্টগ্রামে নয়, আন্তঃজেলায় গণপরিবহন ও মালবোঝায় ট্রাক, লরি ও কার্গো থেকেও চাঁদাবাজি ও ডাকাতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি পুলিশের অনুপস্থিতি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে বলে পরিবহন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি থেকে জানা গেছে। হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশের অপ্রতুল অবস্থান মূলত পরিবহন খাতে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিগত সরকারের আমরে যেভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরিবহন খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়, এখনও একই অবস্থা। যাত্রী কিংবা পণ্য পরিবহন- সব ক্ষেত্রেই চাঁদা ছাড়া গাড়ির চাকা ঘোরে না।
বলা বাহুল্য, দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে সড়ক পথের ওপর ভর করে। ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসা নির্ভরশীল সড়ক পথের ওপর। তাই যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে বাড়ছে বাস-ট্রাকের চাহিদা। এই খাতের ব্যবসায়ীরা পরিবহন নিবন্ধন শুরু করেন উৎকোচ দেওয়ার মাধ্যমে। অফিসের উৎকোচ সড়কে নেমে হয়ে যায় চাঁদা। পরিবহনের চাকা ঘুরলেই নেতা, পুলিশ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, শ্রমিক-মালিক সংগঠন- টাকার ভাগ যায় সব টেবিলে। এ বিষয়টি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বারবার উঠে এসেছে। টিআইবির একটি গবেষণা বলছে, শুধু যাত্রী পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরাই প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দেয়। পণ্য পরিবহনের হিসাব করলে চাঁদার অঙ্ক ছাড়াবে ২ হাজার কোটি টাকা। দেশের আন্তজেলা-দূরপাল্লা রুটের বাসের ক্ষেত্রে বাসপ্রতি গড় ঘুষের পরিমাণ ১ হাজার ১৯ টাকা, আন্তজেলা-আঞ্চলিক রুটের বাসের ক্ষেত্রে ১ হাজার ১৩৩ এবং সিটি সার্ভিসের বাসের ক্ষেত্রে গড় ঘুষের পরিমাণ ৫ হাজার ৬৫৬ টাকা। বছরের হিসাবে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা গুনতে হয় পরিবহন-খাতসংশ্লিষ্টদের।
গণপরিবহনে যেমন রুট মালিক ও মালিক-শ্রমিক সমিতির নামে সরাসরি চাঁদাবাজি চলে, তেমনি আন্তজেলা ট্রাকের ক্ষেত্রে মাসোহারা হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন টোকেন দিয়ে নীরব চাঁদাবাজি করে। আর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ঢোকার মুখে চাঁদা তুলতে সরব স্থানীয় মাস্তানদের লাঠিয়াল বাহিনী। পণ্যবাহী ট্রাকচালকরা চাঁদা না দিলে তারা হামলে পড়ে। রাজধানীতে আবার যাত্রীবাহী পরিবহন ও ট্রাকের চাঁদাবাজির ধরন আলাদা। বাসগুলোর ক্ষেত্রে মূলত কেন্দ্রীয়ভাবে মালিক সমিতিগুলো এটি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে পণ্যবাহী ট্রাকে এমন কেন্দ্রীয় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চাঁদার কারণে পরিবহন মালিক-শ্রমিক তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেনই, খরচ সমন্বয় করতে গিয়ে দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যেরও। সরাসরি এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি হওয়া সাধারণ মানুষদের উদ্ধারে তাই সরকারকে কঠোর হতে হবে। গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ট্রাক-কাভার্ডভ্যানসহ সব ধরনের যানে অবৈধ চাঁদাবাজি রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।