সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
সন্তান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার জন্য এক বিশেষ দান ও পৃথিবীর সৌন্দর্য্যের প্রতীক ও শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র হাদীসে সন্তানদেরকে পার্থিব জীবনের সৌভাগ্য, সর্বশ্রেষ্ঠ সুসংবাদ ও চোখের প্রশান্তি রূপে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘ধনৈশ্বর্য এবং সন্তান সন্তুতি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য।’(কাহ্ফ-৪৬)। তিনি আরও এরশাদ করেন, ‘এবং যারা কামনা করে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দান করো এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি, যারা হবে আমাদের জন্য নয়নের শীতলতা এবং আমাদেরকে করো খোদভীরুদের ইমাম।’(সূরা ফুরকান-৭৪)
সন্তানের অধিকার বলতে কী বুঝায় : একটি সন্তানের অধিকার তার জন্মের আগ থেকেই শুরু হয়। যখন একজন জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী নির্বাচন করতে যায় তখন থেকেই সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে তাঁর কাছে সন্তানের অধিকার সম্পর্কিত একটি অভিযোগ এলে তিনি সন্তানের তিনটি হক্ব বা অধিকার সম্পর্কে তাগিদ দেন।
১ম অধিকার : তার পিতা একটা ভাল মায়ের ব্যবস্থা করবে। এটা এ জন্য যে, সাধারণত: ভাল মায়ের গর্ভেই ভাল সন্তান হয়। তাই ভাল সন্তান চাইলে তার জন্য একটা ভাল মায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
২য় অধিকার : সন্তানের ভাল নাম রাখতে হবে। কেননা ভাল নামের রয়েছে ভাল প্রভাব আর খারাপ নামের খারাপ প্রভাব। এ জন্যেই ইসলাম ভাল অর্থপূর্ণ নাম রাখতে গুরুত্বারোপ করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থ সুন্দর না হলে ঐ নাম পরিবর্তন করে একটা ভাল অর্থপূর্ণ নাম রাখতেন। ইমাম মুসলিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এক কন্যার নাম ছিল ‘আসিয়া’ (অবাধ্য)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘জামীলা’ (সুদর্শনা)।
৩য় অধিকার হল: তাকে দ্বীন শিক্ষা দেয়া।
নিম্নে কিছু অধিকার তুলে ধরা হলো :
নবজাতকের কানে আযান দেওয়া : প্রত্যক নবজাতকের সর্বপ্রথম অধিকার হল জন্মগ্রহণের অব্যবহিত পরেই তার কানে আযানের শব্দমালা উচ্চারণ করা। আবু রাফায়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, যখন হযরত হাসান ও হোসাইনের জন্ম হয় তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের কানে আযান দেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নবজাতকের ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামতের আদেশ দিয়েছেন। (তাবরানি)
নবজাতকের নামকরণ : সন্তানের আরেকটি মৌলিক অধিকার হলো তাকে একটি সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম উপহার দেয়া। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের সুন্দর নাম রাখার জন্য পিতা-মাতাদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নাম ধরে এবং তোমাদের পিতার নাম ধরে। তাই তোমাদের সন্তানদের ভাল নাম রাখো।’ (আহমদ, আবু দাউদ)
তাহনিক ও দোয়া : নবজাতকের আরেকটি অধিকার হলো ‘তাহনিক’ অর্থাৎ খেজুর চিবিয়ে সেই চর্বিত খেজুরের কিছু অংশ অথবা মিষ্টি দ্রব্য নবজাতকের মুখে লাগানো; যাতে এর কিছু রস তার পেটে পৌঁছে যায়। যখন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু জন্মগ্রহণ করেন তখন নবীজি তাকে কোলে ওঠিয়ে নিয়ে একটি খেজুর চিবান এবং চর্বিত খেজুরের একটি অংশ তার মুখে রাখেন। অতঃপর তিনি তার জন্যে দোয়া করেন। (বুখারি, মুসলিম)
আকিকা প্রদান : আকিকা ইসলামের একটি তাৎপর্যমÐিত সুন্নাত। সাধ্য সাপেক্ষে পালন করা মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। শিশুর উত্তম আদর্শময় নিরাপদ জীবন আকিকার দায়ে আবদ্ধ থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘প্রতিটি শিশু তার আকিকার দায়ে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করা হবে, তার নাম রাখা হবে এবং তার মাথা মুÐন করা হবে।’ (তিরমিজি, আহমাদ ও নাসায়ী)
ছেলের জন্য দুটি ছাগল এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল জবাই করা মুস্তাহাব। কেবল একটি মাত্র ছাগল জবাই করারও অনুমতি রয়েছে। আকিকা কেবল নবজাতকের অধিকারই নয়; বরং তা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। আকিকার গোস্ত পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বিলি-বন্টন করা হয়। এটি পুরো সমাজের মধ্যে একটি আনন্দ ও খুশির উপলক্ষ নিয়ে আসে।
মাতৃদুগ্ধ সন্তানের জন্য আল্লাহর খাস নিয়ামত : মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্মগত অধিকার। এ কারণে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর নির্দেশই দেননি; বরং সুনির্দিষ্ট সময়কালও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ‘আর সন্তানবতী নারীরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধপান করাবে, যদি তারা দুধপান করানোর পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়।” (সূরা আল বাকারা,আয়াত-২৩৩)
এতে যেমন শিশুর অধিকার নিশ্চিত হয়, তেমনি নিশ্চিত হয় মায়ের অধিকারও। এমনকি দুধু মায়ের অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে ইসলামে। সুতরাং এটি শুধু মায়ের কর্তব্যই নয়, বরং ধর্মীয় কর্তব্যও। মায়ের দুধ শিশুর জন্য মহান আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত।
শিশুর সর্বপ্রথম শিক্ষা : পিতামাতা তাদের নবজাতককে তাদের জীবনের প্রথম শিক্ষা দিতে হবে কালিমা তাইয়িবা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “তোমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে জীবনের সর্বপ্রথম উচ্চারিত শব্দ হিসেবে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” (কালেমা তাইয়িবা) শিক্ষা দাও এবং মানুষকে তাদের মৃত্যুর পূর্বে অনুরূপ বলতে নির্দেশনা দাও। (বায়হাকি)
উত্তম গুণাবলী শিক্ষাদান : ‘শিশু বয়সে ইলম শিক্ষা পাথরের উপর অংকনের মত স্থায়ী, আর বৃদ্ধ বয়সে ইলম শিক্ষা পানির উপর দাগ টানার মত অস্থায়ী’ [বায়হাকী ও মাকাসেদুল হাসানা]। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “মাতা-পিতা সন্তানের জন্য যা রেখে যায় বা যা উপহার দেয় তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম উপহার হল উত্তম আদব।” (তিরমিযী) তিনি আরও এরশাদ করেন, ‘তোমাদের সন্তান-সন্ততিকে উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দান করবে এবং তাদেরকে সর্বোৎকৃষ্ট চারিত্রিক গুণাবলীতে সজ্জিত করবে।’ (আবু দাউদ) ছেলে-মেয়েদেরকে চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দেয়া দান-সদকার চেয়েও অধিক সওয়াবের কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘কোন ব্যক্তির তার সন্তানকে সৎ চারিত্র ও গুণাবলী শিক্ষা দেয়া এক সা (ওজন পরিমাপের একটি) পরিমাণ দান করার চেয়েও উত্তম। (তিরমিযি) তিনি আরও এরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক নবজাতক শিশুই ‘ফিতরাত’ (ইসলাম) এর উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে খৃস্টান, ইয়াহুদী কিংবা অগ্নিপুজারী করে গড়ে তোলে।”(বুখারি, মুসলিম)
শিশুরা হচ্ছে মাতা-পিতার নিকট রক্ষিত আমানত। আর এ আমানত সম্পর্কে আখেরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘তোমাদের সবাই ধর্মোপদেশক এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার অধীনস্ত বা নির্ভরশীলদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বুখারি, মুসলিম)
মিথ্যা ওয়াদা না করা : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশু-কিশোরদের সঙ্গে খেলাচ্ছলেও মিথ্যা বা প্রতারণা করতে নিষেধ করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে বসা ছিলেন। এমন সময় আমার মা আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে কিছু দেয়ার ওয়াদা দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কী দিতে ইচ্ছা করছেন? আমার মা জানালেন যে, তিনি আমাকে একটি খেজুর দিতে ইচ্ছে করছেন। অতঃপর তিনি বললেন, যদি তুমি একটি মিথ্যা ওয়াদা দিয়ে তোমার সন্তানকে আহবান কর, তবে তা তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হবে। (মুসলিম)
নামাযের আদেশ প্রদান করা : শিশুদের অধিকাংশ অভ্যাসই সাত থেকে দশ বছরের মধ্যে গড়ে ওঠে। যদি পিতামাতা এ সময় তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিতভাবে আদায়ের শিক্ষা প্রদান করে, আশা করা যায় তা তাদের জীবনে স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘তোমাদের ছেলেমেয়েদেরকে সাত বছর বয়সে নামাযের আদেশ প্রদান কর এবং তারা দশ বছর বয়সে উপনীত হলে নামাযের জন্য তাদেরকে হালকা প্রহার কর (যদি তারা নামায না পড়ে) এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।” (আবু দাউদ)
কুরআন মাজিদ শিক্ষা দেওয়া : পিতামাতার উচিত তাদের সন্তানদেরকে কোরান মাজিদ শিক্ষা দেওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি কোরান মাজিদ শিক্ষা করবে এবং তার নির্দেশনা মেনে চলবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে তার পিতামাতাকে এমন এক নূরানী তাজ পরিধান করাবেন যার উজ্জ্বলতা সূর্য থেকেও অধিক হবে। (আবু দাউদ, আহমদ)
প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের সাথে সমতাসুলভ আচরণ করা : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছেলে ও মেয়ে সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য না দেখানোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি এরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখ।’ (বুখারি ও মুসলিম) নুমান ইবনে বশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদা তার পিতা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিয়ে যান এবং তাঁকে জানান যে, তিনি আমাকে একটি ক্রীতদাস দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি তার সকল ছেলেমেয়েকে একটি করে ক্রীতদাস দিয়েছেন কিনা। আমার পিতা উত্তর দিলেন, তিনি তেমনটি করেন নি। নবীজী বললেন, ‘আল্লাহর প্রতি তোমার কর্তব্যকে স্মরণ রাখ এবং তোমার সকল ছেলেমেয়ের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি বলে দেন যে, আমি একটি অন্যায় কাজে সাক্ষ্য হতে চাই না।’ (বুখারি, মুসলিম)।
ইসলামে সন্তানদের জন্য রয়েছে এ ছাড়াও অনেক স্বীকৃত অধিকার। এ অধিকারগুলো রক্ষায় প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মহানবী তাদের জন্য রেখে গেছেন তাদের জন্ম থেকে শুরু করে জীবন চলার পথে প্রয়োজনীয় সব অধিকার সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ