সন্তানকে প্রাণোচ্ছ্বল করার গুরুত্ব ও একটি সুইডিশ রহস্য

1

ফজলুর রহমান

গ্রীষ্ম চলছে। মুধমাস জ্যৈষ্ঠর আমেজে প্রকৃতি। কিন্তু কাঁচা আম থেকে পাকা আম পর্বের কত মধুর ধাপ আছে তা কি জানে নতুন প্রজন্ম! তারা কয়জন বুঝে যে, পাকা আমের শাখায় উঠে মধুর রসে মুখ রঙিন করা যায়!
আসলে এখন অনেকটা কেবল বইয়ের পাতায় অনাদরে পড়ে থাকে- “ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ? কারো মনে উঠে আসে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দুই বিঘা জমিতে লেখা সেই লাইন, “সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,/অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।’ গাছের নিচে শীতল ছায়া খুঁজে বেড়ানোর দিন বুঝি শেষ। গায়ে গামছা ঝুলিয়ে, কিংবা তালপাতার হাতপাখা ঘুরিয়ে দেহ-মনের প্রশান্তির আনার সেই নান্দনিক দৃশ্য আর নেই বললেই চলে।
এখন কৃত্রিম আলো, কৃত্রিম বাতাস সবখানে কদর পাচ্ছে। এসিতে, ফ্যানে মেজেছে জীবন। শহুরে আলো-হাওয়া আর জৌলুসে বড় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। বেড়ে উঠছে যন্ত্রের মধ্যে, যান্ত্রিক হয়ে। হাতের কাছে ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোনসহ নানা ডিভাইস। সবুজ প্রশান্তি কী, গ্রাম কী, বিস্তীর্ণ মাঠ, বিল, ডোবা কী, আম কুড়ানি-জাম পাড়ানি কাহারে কহে সব ভুলে যাচ্ছে তারা। নতুন প্রজন্মের কাছে মানুষ বলতে মা-বাবা আর ভাইবোন। ‘ কেমন আছো, ভালো আছি’- এইটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকে কুশলবিনিময় পর্বটি। দিনে দিনে প্রজন্মটি হয়ে পড়ছে শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, স্মার্টফোন কিশোর মস্তিকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিষয়টা নাকি আগেই বুঝেছিলেন ষ্টিভ জবস আর বিল গেটস। এক সাক্ষাতকারে মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছিলেন তাঁর মেয়ের বয়স ১৪ হওয়ার আগ পর্যন্ত মুঠোফোন ধরতে দেননি। ২০০৭ সালে তাঁর মেয়ে একটি ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়লে বিধিনিষেধ আরোপ করেন। অপরদিকে ২০১১ সালে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকাে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহীর ষ্টিভ জবস বলেছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবিত নতুন আইপ্যাড সন্তানদের ব্যবহার করতে দেননি। জবস বলেছিলেন, ‘আমার বাড়িতে সন্তানদের প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত রেখেছিলাম।’ তারা চাননি শিশুকিশোররা অল্প বয়সে স্মার্টফোন হাতে নিক। এত বড় বড় ব্যবসা গড়ে তোলায় যাদের অবদান তুলনাহীন, তারাই শিশুদের ডিভাইস থেকে দূরে রাখার কথা ভেবেছেন।
অপরদিকে আমাদের সমাজে নানা করণে এখন বেশিরভাগ শিশুর হাতে ফোন এসে যাচ্ছে স্কুল বয়সেই। এতে করে তারা স্মার্টফোনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। যোগাযোগ বা কোনো কিছু জানার আগ্রহ হলে সে ফোনেই সব করে নিচ্ছে। এতে করে শিশুর দূরত্ব বাড়ছে পরিবার ও প্রকৃতির সঙ্গে। যার প্রভাব তার পুরো জীবনে পড়বে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষকরা দেখেছেন বর্তমানে গড়ে ১০ বছর থেকেই শিশুরা ফোন ব্যবহার শুরু করে। ইন্টারনেটের যুগের শিশুরা ডিজিটাল ডিভাইস হাতে বড় হচ্ছে। এর ফলে সমাজের কাঠামো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্কের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষের আবেগ প্রকাশের উপায়। বেশিরভাগ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী শিশু-কিশোরই বন্ধু ও পরিজনদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই শিশুরা বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতেও পছন্দ করে না। ফলে তাদের মধ্যে ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া,সারাক্ষণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় দৃষ্টিশক্তিরও ক্ষতি হওয়া, তাদের মনোযোগ ও ধৈর্য কম হওয়ার প্রবণতা মহামারীতে রূপ নিয়েছে।
এখনকার শিশুরা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্মার্ট, বেশি বুদ্ধিমান। এখন তাদের পৃথিবীটা বড়। তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা আর আত্মসম্মানবোধও অনেক বেশি। সকলেই চান যে, সন্তানরা বেড়ে উঠবে ভালোবাসা আর মমতার ভেতর দিয়ে পারিবারিক বন্ধনে। সোনালী মাঠ, সবুজ প্রান্তর আর বিস্তীর্ণ আকাশ, ক্ষেতের আলপথ, সকালে ফুটে থাকা রাতের ঝরা শিশির, খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটা তাদের জীবনাচরণে যোগ করা দরকার। অবশ্যই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় থাকবে, তবে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে সাথে নিয়ে হতে হবে।
এটি কিভাবে ঘটতে পারে? শাসনে? গবেষণার তথ্য বলছে, যেসব শিশু অতিমাত্রায় কড়া শাসনের মধ্যে বড় হয়, তারা পরবর্তী জীবনে বেশি আতঙ্কের মধ্যে থাকে। এ ধরনের শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তিক্ততা থেকে এসব শিশু-কিশোর অধিকাংশ সময় পরিবার ছাড়াও অন্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে ফেলে। গবেষকরা বলছেন, সন্তানের কঠোর অভিভাবক না হয়ে বরং ভালো বন্ধু হতে চেষ্টা করতে হবে। বাকি ভালো গুণগুলো সে প্রকৃতি থেকেই শিখে নেবে। সুস্থ-সুন্দর-সফল-মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সময় পেলেই শিশু-কিশোরদের প্রকৃতির মাঝে নিয়ে যেতে হবে। তাদের চারপাশের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিতে হবে। ছোট বেলা থেকেই শিশুকে দেশ, মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখাতে হবে।
এক্ষেত্রে সন্তানকে প্রাণোচ্ছল করে তুলতে ১৬৫ বছর আগের একটি সুইডিশ রহস্য মেনে চলতে পারি আমরা। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি প্রতিবেদনে এই রহস্য উন্মোচন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে থাকে নর্ডিক দেশগুলো। এর মধ্যে অন্যতম সুইডেন। দেশটিতে ১৬৫ বছর আগে থেকেই একটি বিশেষ জীবনধারার চর্চা আছে, যার মাধ্যমে শিশুকে সহজেই ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। ধারণাটি ‘ফ্রিলুফৎসলিভ’ বা ‘ওপেন এয়ার লাইফ’ নামে বহুল পরিচিত, যার অর্থ প্রকৃতিকে আপন করে নেওয়া ও বাইরের পরিবেশে সময় কাটানো। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার এই জীবনদর্শন সুইডিশ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চলুন জেনে নিই, কীভাবে এই দর্শন আপনার সন্তান পালনে কাজে লাগাতে পারেন।

বাইরে যাওয়ার জন্য সময় নির্ধারণ করুন
বর্তমানে টেলিভিশন, মুঠোফোনসহ নানা প্রযুক্তির ব্যবহারে শিশুরা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। যার ফলে তাদের মনোযোগেও দেখা দিচ্ছে ঘাটতি। অথচ মানুষ প্রকৃতিরই অংশ। প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটালে শিশুর মানসিক বিকাশ হয় ভালোভাবে। তাই মা-বাবার উচিত প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় শিশুদের প্রকৃতির মধ্যে কাটানোর সুযোগ করে দেওয়া। নাগরিক জীবনে অসম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু আগেভাগেই সময় নির্ধারণ করলে তা সহজ হয়ে যায়। সুইডিশ সংস্কৃতিতে সকাল বা সন্ধ্যার হাঁটাকে ‘পবিত্র কাজ’ মনে করা হয়। সন্তানকে নিয়ে প্রতিদিন এ সময় হাঁটার অভ্যাস তৈরি করলে প্রকৃতির কাছাকাছি আসার পাশাপাশি মা-বাবার সঙ্গে শিশুর সম্পর্কও দৃঢ় হয়।

যেখানে আছেন, সেখান থেকেই শুরু করুন
প্রকৃতির সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যে এখনই বনজঙ্গলে গিয়ে ক্যাম্পিং করতে হবে, এমনটা নয়। প্রথমে শিশুকে আশপাশের প্রকৃতি চেনানো দিয়ে শুরু করুন। গাছপালা, পাখি, ফুল, রঙিন পাতা, প্রজাপতি কিংবা কাঠবিড়ালি চেনান। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গাছের পাতার নড়াচড়া দেখা কিংবা বৃষ্টির শব্দ শোনার মধ্যেও প্রকৃতির সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হতে পারে।
আবহাওয়া যেন বাধা না হয়
ঋতু পরিবর্তনে আবহাওয়াও পরিবর্তন হয়। বর্ষার সময় যেমন বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনায় বিঘœ ঘটাতে পারে। দূষণ বা অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে যেকোনো আবহাওয়ায় শিশুকে প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আবহাওয়া ঠান্ডা হলে গরম জামাকাপড় পরিয়ে দিন, হালকা বৃষ্টিতে রেইনকোট বা ছাতা হাতে বাইরে বের হওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। অনেক সময় বৃষ্টিতে ভেজা, কাদা মাড়িয়ে হাঁটার অনুভূতিই হয়ে ওঠে শিশুর শৈশবের সেরা স্মৃতি।
মনে রাখতে হবে, শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের অনেক কিছুই নির্ভর করে তার বেড়ে ওঠার ওপর। এই সময় মা-বাবার আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি শিশুর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সব অভিভাবকেরই ইচ্ছা থাকে তাঁদের সন্তান যেন হাসিখুশি, আত্মবিশ্বাসী ও বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে গড়ে ওঠে। সন্তানের সঠিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে সুইডিশ কৌশলটি তাই সকলে মেনে চলতে পারি।

লেখক : উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), চুয়েট