সতর্কতা জরুরি

2

গত বুধবারসহ মাসের শুরুতেই পরপর দুইবার ভূমিকম্পে কেঁপেছে দেশ। যদিও ভূমিকম্পের মাত্র ছিল কম ও স্বল্প সময়, তবুও এ জাতীয় ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস দেয়। এর আগে জানুয়ারি ও ফেব্রæয়ারি মাসেও দেশে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্পগুলোতে তেমন কোনো ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হওয়াটা স্বস্তির বিষয়। তবে দুই মাসের ব্যবধানে বারবার এমন ভুমিকম্পের ঘটনায় স্বস্তির কোনো কারণ আছে বলে মনে হয না। সাধারণ মানুষ একে সাময়িক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের ভূমিকম্প ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস হতে পারে। এজন্য আমাদের করণীয় এবং প্রস্তুতির দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। কিন্তু আমাদেও অভিজ্ঞতায় বলে, কোন বড় দূর্ঘটনা একবারে আমাদের ঘাড়ে এসে না পড়লে সেটির দিকে আমাদের মনোযোগ থাকে খুব কম। কিন্তু মনে রাখা চাই, ভূমিকম্প এমন একটি দুর্যোগ, যার পূর্বাভাস জানার কোন সুযোগ ইেন। তবে ছোট ছোট ভূমিকম্প এবং প্রাকৃতিক আবহাওয়া আমাদের বারবার সতর্ক করে যায়। কিন্তু আমরা সাবধান হই না। ফলে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আমাদের ঘিরে রাখছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা সব সময় বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মা টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই অঞ্চলকে ভূতাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞরা ‘সিসমিক জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ ভূতাত্তি¡ক জরিপ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের ৯০% ভবন ভূমিকম্প সহনশীল নয়। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং আন্তর্জাতিক ভূতাত্তি¡ক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকা শহরে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে অন্তত ৭০ হাজার ভবন ধসে পড়বে এবং অন্তত ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি এবং ১ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সংখ্যাটা বেশ আতঙ্কের। ছোট ছোট ভূমিকম্প বা মাইক্রো-সিসমিক কার্যকলাপের মাধ্যমে ভূত্বকের নিচে টেকটোনিক চাপ ধীরে ধীরে জমা হয়। জমে থাকা এই শক্তি ছোট ভূমিকম্পের মাধ্যমে আংশিকভাবে মুক্তি পায়। তবে এটি বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা কমায় না। বরং দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি জমতে থাকলে তা বড় ভূমিকম্পের রূপ নিতে পারে। আমরা মনে করি, ভূমিকম্প মোকাবেলায় স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে ভূমিকম্প বিষয়ক গবেষণা বাড়াতে হবে। বিদেশের বিভিন্ন দেশের ভূমিকম্প প্রতিরোধ ও মোকাবিলার জন্য নেওয়া প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, প্রকল্প থেকে শিক্ষা গবেষণা করা যেতে পারে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের উদ্ধার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জরুরি সেবা প্রদানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বিভিন্ন সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। জনসাধারণকে ভূমিকম্প মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে অবগত করতে হবে। প্রতিটা অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে আশ্রয়কেন্দ্রে আগে থেকেই নির্মাণ এবং প্রস্তুত রাখতে হবে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মেরও ভূমিকম্প মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্পবিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করতে পারে। ভূমিকম্প পূর্বাভাস ও মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে অংশগ্রহণ করতে পারে। দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করে জনগণের কল্যাণে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এক্ষেত্রে রেডক্রিসেন্টকে আরো ব্যাপক আধুনিকায়ন ও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুর। দেশের যেকোন দুর্যোগে রেডক্রিসেন্ট এর ভূমিকা অপরিহার্য। এরছাড়া তরুণ স্থপতি ও প্রকৌশলীরা ভূমিকম্প সহনশীল নির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রাকৃতিকভাবেও ভূমিকম্প মোকাবেলায় উদ্যোগ নেয়া যায়। বিশেষ করে পাহাড় নিধন, খাল বিল জলাশয় ভরাট কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। তালগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপনে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। আগেই বলা হয়েছে, ছোট ছোট ভূমিকম্প প্রকৃতির এক ধরনের সতর্কবার্তা। এটি উপেক্ষা করা মানে ভবিষ্যতের বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া। সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, সমাজসেবীমূলক সব প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাস করতে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে, ভবিষ্যতে একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প দেশের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূমিকম্প মোকাবেলায় এখনই উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে দেশ ও দেশের মানুষ বড়ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে পারে।