সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে এক ধরনের মহামারিতে রূপ নিয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়। দীর্ঘ তিন যুগেরও অধিক সময় ধরে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা, পদক্ষেপ ও আইন প্রণয়ন করেও কোন কাক্সিক্ষত সুফল লাভ করতে পারে নি। বরং দিনের পর দিন সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে, সেই সাথে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে এ আন্দোল ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে অল্প সময়ে ছড়িয়ে পড়ে। সরকার তখন বাধ্য হয়ে নিরাপদ সড়ক আইন ২০১৮ প্রণয়ন করে ছাত্রদের শান্ত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ আইনের উপর বেশ কয়েকবার সংশোধন-সংযোজন চলার পর দেখা যায়, দুর্ঘটনার জন্য যারা দায়ি থাকেন সেই গাড়ির চালক আর হেলফারদের সুরক্ষায় দেয়া হয় আইনে। ফলে আইন করেও দুর্ঘটনা রোধে কোন সুফল মিলেনি। এখন আবারও দাবি উঠছে কঠোর আইন প্রণয়নে। বাস্তবে যে দেশে বাস-ট্রাকের চালক ও সহযোগিদের নিয়ে রাজনীতি করা হয়, রাজনৈতিক প্রভাব বলয় তৈরি করা হয়, সেই দেশে আইন কওে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমরা দেখতে পাই, দুর্ঘটনায় জড়িতদের অপরাধ ঢাকতে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া আইন যাই হয়েছে, তাও যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ হতো, তবে কিছুটা হলেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আসত। সম্প্রতি বিভিন্ন জরিপে সড়ক দুর্ঘটনার যে বিবরণ উঠে আসছে তা দেখে চমকে উঠার উপক্রম হয়। বিশেষজ্ঞরা এটিকে মহামারির সাথে তুলনা করছেন। জানা যায়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সম্প্রতি যাত্রীকল্যাণ সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছর ৬ হাজার ৩৫৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৬০৮ জন। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে, মৃত্যু বেড়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, আহতের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত বছর রেলপথে ৪৯৭ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫১২ জন নিহত এবং ৩১৫ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া নৌপথে ১১৮ দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত, ২৬৭ জন আহত এবং ১৫৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন। গত এক বছরে সড়ক, রেল ও নৌপথের দুর্ঘটনা এবং হতাহতের এ চিত্র যাত্রীদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেবে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেছেন, শুধু সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তারমতে, সড়ক দুর্ঘটনা প্রকৌশলগত ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। সমাধানও প্রকৌশলগত হওয়া জরুরি।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির নেতা মোজাম্মেল হক মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো-বেপরোয়া গাড়ির গতি, সড়কের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, চালক-যাত্রী-পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, পরিবহণ চালক ও মালিকের বেপরোয়া মনোভাব। কাজেই দেশে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে আলোচিত সমস্যাগুলোর সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে। জানা যায়, দেশে সংঘটিত মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ ফিডার রোডে এবং ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরে সংঘটিত হয়েছে। এ চিত্র থেকেও ধারণা পাওয়া যায়, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো কতটা অনিরাপদ।
গত কয়েক দশকে দেশে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও কেন দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে, তা বহুল আলোচিত। সমস্যাগুলোর সমাধানে কী করণীয় তা-ও বহুল আলোচিত। ক্লান্ত-শ্রান্ত চালক গাড়ি চালালে স্বভাবতই তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। কর্তৃপক্ষকে এসব দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। পরিবহণ কর্মীদের জীবনমানের উন্নয়নেও নিতে হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যত পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক না কেন, দুর্নীতি রোধ করা না গেলে, কাক্সিক্ষত ফল মিলবে কিনা সন্দেহ। আমরা আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সড়ক বিভাগ সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমলে নিলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে।