বছর ঘুরে আবারও ফিরে এলো রক্তাক্ত জুলাই। ২০২৪ সালের জুলাই শুরু হয়েছিল লাখো তারুণ্যের এক মহা ঐক্যের বাঁধনে। যে ঐক্য ছিল রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে, যে ঐক্য ছিল, কোটার নামে চাকরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, যে ঐক্যের বাঁধ সৃষ্টি হয়েছিল স্বৈরাচার, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তারুণ্যের দীপ্ত পায়ে চলা এ ঐক্য গড়ে উঠেছিল টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া। এ ঐক্যেই রচিত হয়েছিল জুলাই বিপ্লব। যেখানে বুকে আগুন ছিল, মুখে বারুদময় স্লোগান ছিল আর রাজপথ হয়ে উঠেছিল লাল রক্তের কার্পেট। আজ সেই জুলাইয়ের একবছর। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জুলাই বিপ্লবের শহীদদের যাদের রক্তাক্ত নিথর দেহ একটি সজিব সুন্দর ও নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টির পথকে সুগম করেছিল। ষোড়শি কর্দমাক্ত রাক্ষুসি স্বৈরাচারের বিদায় ঘণ্টা বাজাতে বাধ্য করেছিল। এ জুলাই শুধু স্মৃতির স্মরণখোলা না হোক, হোক অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দ্রোহের প্রেরণা। এ জুলাই হয়ে উঠুক একাত্তরে একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রকৃত অর্জন।
আজ খুব মনে পড়ে ২০২৪ এর জুলাইকে। ওই সময় জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল নারকীয় সব কাÐ, স্বৈরাচারের মোহকামুক শক্তি ছাত্র জনতার এক্যের বাঁধ ঠেকাতে একে একে কেড়ে নিয়েছিল ছাত্র ও সাধারণ মানুষের অগণিত প্রাণ। এই জুলাই মাসেই হত্যা করা হয়েছিল আবু সাঈদকে। সেখান থেকেই প্রজ্বলিত হয়েছিল বিদ্রোহের আগুনের সর্বদিকবিস্তৃত শিখা। একটা সরকার কতটা নিপীড়ক হলে অল্প সময়ের ব্যবধানে সরকারি গেজেট অনুযায়ী ছাত্র-জনতার ৮৩৪ জনকে হত্যা, হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু করা সম্ভব?
এই নৃশংসতার কোনো তুলনা নেই। হ্যাঁ, আন্দোলনের একটা পর্যায়ে গত রেজিমের পতন ঘটানোর জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অসীম সাহসিকতায় গুলির সামনে পেতে দিয়েছিল বুক। গুলি করতে করতে হয়রান সরকারি বাহিনী এক পর্যায়ে রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। পরের মাস অর্থাৎ আগস্টের প্রথম সপ্তাহের ৫ম দিনেই সরকারের পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনা তার বোনকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এর পরপর পতিত সরকারের নেতা আমলা হুমরারা দেশত্যাগ করে একযোগে পালিয়ে যায় ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। একটি সরকার কতটুকু স্বৈরাচার ও দুর্নীতিবাজ হলে সব নেতা, আমলা ও হুমরা দেশ ত্যাগ করে, এর প্রমাণ গত বছরের জুলাই-আগস্ট। ২০২৪ এর জুলাই আমাদের জন্য শিক্ষার মাস। ছাত্র-জনতার সুদৃঢ় ঐক্য, একটি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নিজেদের জয় নিশ্চিত করারশিক্ষা দেয়। যে কোন স্বৈরচার, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে জাতির ঐক্য সবচেয়ে বড় শক্তি। ঘুষ, দুর্নীতি, ঘুম, খুন ও ক্ষমতার দাপট কারো জন্য চিরস্থায়ী নয়, সময় বলে দিবে প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে একেকটি জুলাই আসবেই। জুলাই বিপ্লব শুধু দেশে নয়, জুলাইয়ের মহিমা ও মাহাত্ম্য বিশ্ববাসীকেও বিস্মিত করেছে যেমন, তেমন তাদেরকেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস জুগিয়েছে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, জুলাইয়ের স্মৃতি থাকবে ততদিন অমলিন।
জুলাই বিপ্লবের এক বছর পার হতে চলেছে। যে আকাক্সক্ষা ও আদর্শকে সামনে রেখে এই বিপ্লব বা অভ্যুত্থান হয়েছিল, এক বছর পর সেই অভ্যুত্থানের স্পিরিট কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বৈরাচারমুক্ত এমন এক গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করব, যেখানে থাকবে না গত রেজিমের মতো আর্থিক লুটপাট, যেসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, বিনির্মাণ হবে সেগুলো, বাংলাদেশ নির্বিঘেœ এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। কিন্তু আমরা দুঃখ ও হতাশার সঙ্গে লক্ষ করছি, ছাত্রসমাজ-জনতা ও যেসব রাজনৈতিক দল এ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল, অভ্যুত্থান শেষে অনেক ক্ষেত্রে তাদের ঐক্যে ফাটল ধরেছে। এ কারণে বিজয়ের পর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই সরকারকে নিরবচ্ছিন্ন স্থিতিশীল পরিবেশে কাজ করতে বাধা পেতে হয়েছে। রাষ্ট্রের যেসব বিষয়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, সেসব বিষয়ে এখনও পূর্ণ ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। তবে আশার কথা, এ সংস্কারের প্রশ্নে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া চালু রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই অনেকে পুরোনো অবস্থান থেকে সরে এসে ঐকতানে সুর মেলাচ্ছেন। আমরা আশা করতে চাই, সংস্কার প্রক্রিয়া শেষে প্রতিশ্রুত সময় ফেব্রুয়ারিতেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াও এগিয়ে যাবে সমান তালে। জুলাই চেতনা আমাদের যেন ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে, সকল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এ জুলাই চির জাগরুক থাকবে-এমনটি প্রত্যাশা দেশবাসীর।