গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হয়। এরপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশের শাসনভার হস্তান্তর করা হয় অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপর। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের এ সরকারের মেয়াদ প্রায় ৫০ দিন। সরকার নানামুখি সংস্কার, পরিকল্পনা গ্রহণের দিকে মনোযোগী হলেও এখনও নির্বাচন কখন হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট না করায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের হতাশার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তারা যদিও সংস্কার প্রশ্নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন, কিন্তু নির্বাচন নিয়ে একধরনের অস্তিরতাও দৃশ্যমান হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর প্রধান আশ্বস্ত আস্বস্থ করতে চেয়েছেন, আগামী আঠারো মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বাংলাদেশ একটি বিশেষ সময় অতিক্রম করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিপ্লবী ছাত্র-জনতার চাহিদা বা এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে দেশ পরিচালনা করবে-এটিই স্বাভাবিক। সরকারের যদিও বড় কাজটি হচ্ছে, সকল দল ও মতের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আয়োজন করা, কিন্তু এর আগে নির্বাচনের পরিবেশসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে বেশকিছু সংস্কার অপরিহার্য। যা নিয়ে ইতোমধ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে। এরপর প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শেষ করে সরকার একটি ‘যৌক্তিক’ সময়ের পর জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করবে এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেছেন, দেশের মানুষের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, সেসব সংস্কার যেন টেকসই হয়, তা দীর্ঘ মেয়াদে নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে। শনিবার দৈনিক পূর্বদেশসহ সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ সময় রাতে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমরা বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থা সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠন করেছি। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সংস্কারের জন্যও পৃথক কমিশনসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে বা সংস্কার করতে কতদিন যাবে, কবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেননি। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও নানা মত আছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দ্রæত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হলে যে দলটির জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি, সেই বিএনপি চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকাল দীর্ঘায়িত না হোক। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন নির্বাচন সংস্কারের জন্য একটা যৌক্তিক সময় সরকার নিতে পারে। তবে তিনি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যৌক্তিক সময় মানে এই না যে, তারা অনেক বেশি সময় নিয়ে নেবে। যত দ্রæত নির্বাচন আয়োজন করা যাবে ততই দেশের মঙ্গল হবে। অপরদিকে লক্ষ করা যায়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু ছোট দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দিতে আগ্রহী। তারপরও দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান শুক্রবার বলেছেন, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে সম্মানের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিদায় নিতে হবে। কেননা, বছরের পর বছর দেরি করলে আগাছা জন্ম নিতে পারে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে, তৃতীয় শক্তির উদ্ভব হতে পারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও স্বাভাবিকভাবেই এসেছে পরিবর্তন। ছাত্রদের কোটা সংস্কার, এরপর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন এরপর নয়দফা ও একদফা আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে।
ছাত্রদের আন্দোলন যাই হোক, তারা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির মধ্যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও ভূমÐলীয় অবস্থান বিবেচনায় মানুষ সহজেই অতীতকে ভুলে যায়। লক্ষ করার বিষয়, দুই মাস যেতে না যেতেই ছাত্র-জনতার তৈরি সেই ঐক্য কিন্তু আর নেই। এখন রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিভাজনে জড়িয়ে পড়েছে আন্দোলনকারী ছাত্ররাও। তা ছাড়া বর্তমান সরকার আওয়ামীলীগের পথে হাঁটলে অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ না দিয়ে কীভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হবে, তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। যেমনটি আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও অন্যান্য দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করেছে এবং দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। আমরা মনে করি, বর্তমান সরকার যেহেতু অরাজনৈতিক সরকার, এ সরকার নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সকল দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
দেশের জনগণ আর যাই হোক একটি উৎসবমুখর নির্বাচন প্রত্যাশা করে। সকল দল অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেই উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরে আসবে-এমনটি প্রত্যাশা।