অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথমবারের মত দেশের ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করেছে গতকাল ২ জুন সোমবার। এবার যেহেতু সংসদ নেই, তাই সঙ্গতকারণে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনায় বিকাল নাগাদ বাজেট উপস্থাপনা করা হয়। উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসেবে গত অর্থবছরের চেয়ে বাজেটের আকার কমেছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। যেখানে জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছর জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে অর্জিত হয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ ভাগ। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। গত এপ্রিলের হিসেবে দেশের বর্তমান সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটিও গত বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এডিপি ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জোগান দেবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে আসবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট লক্ষ্যমাত্রার ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ৬২ ভাগ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট ঘাটতির ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বিদেশি ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বা ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এবার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর ৫৭ ভাগই যাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ পরিশোধে। নতুন বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১০ থেকে ২০ ভাগ মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর কমতে পারে ২ দশমিক ৫ ভাগ। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের কর নামবে ২০ শতাংশে। তবে অপরিবর্তিত থাকছে পুঁজিবাজারের বাইরের প্রতিষ্ঠানের করহার। এসব প্রতিষ্ঠানকে আগের মতোই ২৭ দশমিক ৫ ভাগ কর দিতে হবে। এছাড়া পুঁজিবাজারে ব্রোকারেজ হাউজের সিকিউরিটিজ লেনদেন কর শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে ২৭ দশমিক ৫। গত কয়েক বছরের মতো এবারও কালোটাকা সাদা করা করার সুযোগ থাকছে। প্রতি বছর এ ব্যবস্থাটি নিয়ে বাজেট বিশ্লেষকরা হৈ চৈ ফেলে দেন। এবারও হয়ত তার ব্যত্যয় ঘটবেনা। তবে কালো টাকা সাদা করার মধ্যে সুবিধা কী তা নিয়ে সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য থাকা জরুরি। আমরা যতটুকু মনে করি, এ ব্যবস্থাটি অনিয়ম ও দুর্নীতিকে উৎসাহেত করে। সবচেয়ে বড় কথা এ টাকা দেশের কোন উন্নয়ন খাতে ব্যবহার হয়েছে বা বড় ধরনের বিনিয়োগ কেউ করছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। অতীতে রাজনৈতিক সরকার কালো টাকা সাদা করেছে, তাদের কিছু রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকতে পারে। কিন্তু নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন করবে? বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আমরা মনে করি সরকার এ বিষয়টি বিবেচনা করবে। এছাড়া শিক্ষা খাতে সরকার মাদ্রাসা ও কারিগরিতে বরাদ্দ বাড়ালেও প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়াটা শিক্ষার ফাউন্ডেশনাল সিস্টেমে প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আসবে। বুনিয়াদি শিক্ষার ভীত যত শক্ত হবে তত শিক্ষার গুনগত মান বাড়বে। এক্ষেত্রে সকল পর্যায়ের শিক্ষাকে একই সূত্রে বাঁধা দরকার। বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমায় আগের মতই রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় থাকলেই একজন ব্যক্তিতে আয়কর দিতে হবে। নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা। আর প্রতিবন্ধীদের জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এছাড়া গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা। এবারের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমায় নতুন যুক্ত হয়েছেন ‘জুলাই যোদ্ধারা’। নতুন অর্থবছরে তাদের করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। উদ্যোগটি ভালো, তবে যুদ্ধাহতদের করমুক্ত আয় সীমা আরো বাড়ানো যায় কিনা ভেবে দেখা জরুরি। দেশে যে পরিমান আবাসন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে নির্মাণ খাতের ব্যয় বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষ মাথাগুজার বাড়ি নির্মান করতে হিমশিম খাবে নিশ্চিত। বলা হচ্ছে, রডের দামও বাড়বে। এছাড়া ঈদুল আজহার এ সময়ে আমদানিকৃত মসলার দাম বৃদ্ধি করা মানে ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ সৃষ্টি করা। শিশু খাদ্যের দাম যে হাওে বাড়তি তাতে শিশুদের পুষ্ঠিজনিত খাবার দিতে পরিবারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আবারও দাম বাড়লে শিশুদের জন্য বড় দুঃসংবাদই বলা যায়। এ বিষয়গুলো সরকার বিবেচনায় আনবে আশা করি।
আমাদের দেশের সবচেয়ে সচেতন শ্রেণি হলো মধ্যবিত্ত। এই শ্রেণিটি অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ধরনের অবদান রাখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রতিবছর বাজেটে প্রাপ্য গুরুত্ব তারা পায় না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রধান সমস্যা হলো, তাদের আয় বাড়ে সীমিত হারে, অথচ ব্যয় বেড়ে চলে লাগামহীনভাবে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, চিকিৎসা ও শিক্ষার খরচ, বাড়িভাড়া-সবকিছুই তাদের সংসারে চাপ বাড়িয়ে দেয়। এবার বাজেটে করের আয় সীমা বৃদ্ধি না করলেও মধ্যবিত্তের জন্য উল্লেখযোগ্য কোন সুখবর আছে বলে মনে হয় না। একটি দেশের মানুষ আগামী বছরটায় কেমন জীবন কাটাবে, বাজেটকে হতে হয় সেই জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। জাতীয় বাজেটের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন। মধ্যবিত্তকে স্বস্তি দিলে কেবল একটি শ্রেণিই নয়, গোটা অর্থনীতিই প্রাণ পাবে। তাই মধ্যবিত্তের চাওয়া-পাওয়ার বিবেচনায় একটি মানবিক বাজেট প্রণয়ন সময়ের দাবি।