সওজের কাগজে বৃক্ষ রোপণ, সড়কে নেই!

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুই লেন সড়কের দুইপাশে ছিল সারি সারি গাছ। দুই পাশ থেকে গাছের বাড়ন্ত ঢালগুলো সড়কে ছায়া দিতো। এতেই প্রকৃতি যেন সড়কগুলোকে মায়াময় করে তুলতো। চট্টগ্রামসহ আশেপাশের জেলা-উপজেলায় পথ চলতে সবুজ বৃক্ষরাজিতে ভরা এমন সড়কের দেখা মিলতো বেশ। উন্নয়নের ডামাডোলে এমন সড়ক আর চোখে পড়ে না এখন। প্রশস্ত সড়কে দুই পাশে নেই সারি সারি বৃক্ষ।
অথচ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের বৃক্ষপালন বিভাগের তথ্য মতে, গত তিন বছরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ৯টি সড়কে এক লক্ষ ৬২ হাজার গাছ রোপণ করেছে সওজ। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, এত গাছ গেল কোথায়?
চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের সহকারী বৃক্ষপালন কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম চকদার পূর্বদেশকে বলেন, ‘টেন্ডার করে ঠিকাদারের মাধ্যমে গাছগুলো রোপণ করা হয়। প্রতি কিলোমিটারে দুই হাজার বৃক্ষরোপণ করা হয়। চারা ক্রয়, রোপণ, সার, খুঁটিসহ রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিটি গাছে প্রায় ২২ টাকা খরচ হয়। রোপণের পর গাছগুলো দুই বছর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এ জন্য অস্থায়ীভিত্তিতে প্রতি কিলোমিটারে একজন করে মালি নিয়োগ দেয়া হয়। রোপণকৃত গাছগুলো দৃশ্যমান হতে সময় লাগে’।
চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বৃক্ষপালন বিভাগের সূত্র মতে, ২০২২-২৩ অর্থ বছর থেকে চলতি অর্থ বছর পর্যন্ত তিন বছরে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারের ৯টি সড়কে ১ লক্ষ ৬২ হাজার বৃক্ষরোপণ করা হয়। প্রতিটি সড়কের দুই পাশেই গাছগুলো লাগানো হয়।
২০২২-২৩ অর্থ বছরে পটিয়া ক্রসিং থেকে ইন্দ্রপোল পর্যন্ত আট কিলোমিটার সড়কে ১৬ হাজার, চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি সড়কের ফটিকছড়ি থেকে মানিকছড়ি পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়কে ১২ হাজার, বারইয়ারহাট থেকে হোঁয়াকো সড়কের ১৮ কিলোমিটারে ৩৬ হাজার, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কেরানীহাট থেকে বান্দরবান আট কিলোমিটার সড়কে ১৬ হাজার, সাতকানিয়া-বাঁশখালী-গুনাগরী সড়কে ১৪ কিলোমিটারে ২৮ হাজার, কক্সবাজার-রামু মহাসড়কের পাঁচ কিলোমিটারে ১০ হাজার, পটিয়ার কমলমুন্সির হাট থেকে চন্দনাইশের বাগিচাহাট পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারে ২০ হাজার, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কক্সবাজার-ঈদগাঁও-রামু ফুটবল চত্বর পর্যন্ত আট কিলোমিটার সড়কে ১৬ হাজার, একতা বাজার-পহরচাঁদা-মগনামা ঘাট পর্যন্ত চার কিলোমিটার সড়কে আট হাজার বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। প্রতিটি সড়কেই বনজ, ওষুধি, ফলজ ও বাহারিচারাগাছ রোপণ করা হয়। প্রতিটি সড়কে বৃক্ষরোপণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর কোন অঞ্চলে কোন জাতের গাছ উপযোগী সে হিসেবে চারা রোপণ করা হয়।
কক্সবাজারের ঈদগাঁ উপজেলার হরিপুর এলাকার বাসিন্দা সৌরভ দাশ বলেন, সড়কে অল্পকিছু গাছ লাগানো হলেও তা দৃশ্যমান হয়নি। অথচ তার চেয়ে বেশি গাছ কেটে ফেলেছে। শুরুতেই কিছু গাছ লাগিয়ে খুঁটি বেঁধেই দায় সারে। পরবর্তীতে লাগানো গাছগুলো তদারকি করা হয় না। প্রতি কিলোমিটারে দুই হাজার গাছ লাগানোর বিষয়টি মিথ্যা। আসলেই কত গাছ লাগানো হয়েছে তা খতিয়ে দেখা উচিত’।
পরিবেশবিদরা বলছেন, গত দশ বছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। প্রতিটি সড়কের দুই পাশে থাকা অসংখ্য গাছ কর্তন করা হয়েছে। সড়কের পাশের গাছগুলো কর্তনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলেও সেভাবে গাছ রোপণ করা হয়নি। কয়েকটি সড়কে গাছ রোপণ করা হলেও সেগুলো দৃশ্যমান হয়নি। অনেক সময় গাছ রোপণের পর সঠিক পরিচর্যা না করায় চারা গাছ নষ্ট হয়ে যায়। আবার গাছ রোপণ না করেই রোপণের হিসাব-নিকাশ তুলে ধরা হয়।
চট্টগ্রাম কলেজ রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. ইদ্রিছ আলী পূর্বদেশকে বলেন, বৃক্ষরোপণ করা হলেও ধারাবাহিক তদারকি নাই। কাগজে-পত্রে লক্ষ লক্ষ গাছ লাগানোর কথা বলা হলেও দৃশ্যমান কিছু দেখি না। বিচ্ছিন্ন কিছু লোক দেখানোর অংশ হিসেবে এসব প্রকল্প নেয়া হয়। যেকোনো গাছ লাগানোর সাথে পরিচর্যা, তদারকি করে জনগণের আস্থায় নিতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে বৃক্ষরোপণ করলে সুফল মিলবে না, আকাঙ্খার অংশ হতে পারবে শুধু। ধরে নিলাম গাছ রোপণ করছে, কিন্তু পশু-পাখি তো এ দেশে আছে। দুস্কৃতিকারীরাও আছে। এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা, আঞ্চলিকতার সম্পৃক্ত করতে হয়। এগুলো শূন্যের কোটায় আছে বলেই সুফল মিলে না। বৃক্ষরোপণের মতো কাজগুলো সামাজিকভাবে, ধর্মীয়ভাবে কিংবা পরিবেশের জন্য উপকারের কাজ- সে বোধগুলো মানুষের মধ্যে জাগাতে হবে। সামাকিজকভাবে চেতনা জাগাতে পারলে বৃক্ষরোপণের সুফল আরও বাড়বে। এখন সেটি না করে ১০-২০ টাকা খরচ করে বিল বানিয়ে ব্যবসা করে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি সড়ক উন্নয়নের কারনে প্রচুর গাছ কর্তন করতে হয়। এতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। যে কারনে আমরা যে পরিমাণ গাছের ক্ষতি হবে তার তিন গুণ গাছ লাগানোর পরামর্শ দিই। কিন্তু অনেক দপ্তর আমাদের সাথে প্রাথমিক আলোচনা করলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা যায় গাছ রোপণে অনীহা দেখায়।