রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরকারের কোন মান-অভিমান চলছে কি না, তা আমাদের জানা না থাকলেও আল জাজিরাকে দেয়া অন্তর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরটির মধ্যে অভিমানের সুর অনুরণিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে বর্তমান সরকারের ১০০দিন উদযাপন উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার নির্বাচন নিয়ে জাতিকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, কিন্তু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মহসচিব এ ভাষণে নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনা নেই বলে বিবৃতি দিয়েছেন। আমরা জানি, এদেশের মানুষের কাছে নির্বাচন এবং জনপ্রতিনিধি আবেগ এবং বাস্তবতার বিষয়। নির্বাচনকে দেশের মানুষ যেমন উৎসবের ইস্যু মনে করেন আবার জনপ্রনিধিকে তারা মনে করেন আশির্বাদের ছায়া। বিগত পতিত সরকার উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি করেও মানুষের অন্তরে ঠাঁই পান নি, নামে মাত্র নির্বাচন করে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার হীন প্রচেষ্টার কারণে। একনায়কতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র এ দেশের মানুষ কখনো গ্রহণ করনি, এখনও নয়, ভবিষ্যতেও হয়ত তাই হবে। এ অভিজ্ঞতায় বলা যায়, মানুষ নির্বাচন চায় দ্রুততার সাথে, তবে সংস্কারের কাজটিও এগিয়ে নেয়ার পক্ষে নিঃসন্দেহে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তবর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। বলা যায়, এই সরকারের ওপর ছাত্র-জনতার প্রত্যাশার কোনো শেষ নেই। পতিত সরকার দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার, প্রশাসন, পুলিশ এবং রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক প্রকার দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলছিল। ফলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা রাষ্ট্র পূরণ করতে পারে নি। বিপ্লব পরবর্তী সরকারের উপর মানুষের প্রত্যাশা এ সরকার রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক কাঠামোগুলো সংস্কার করবে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করবে। একটি স্বপ্ন ও সুনির্দিষ্ট কিছু আকাক্সক্ষা নিয়ে ছাত্র-জনতা রক্তাক্ত আন্দোলন ও অভ্যুত্থান ঘটিয়ে স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে। সেই স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার বাস্তাবায়ন সরকারের অপরিহার্য কর্তব্য বলেই গণ্য। কিন্তু ১০০ দিনে সরকারের যতটা সাফল্য আশা করা হয়েছিল, ততটা আসেনি। এর একটা কারণ সম্ভবত এই, প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামন্ডলীর সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা কম। দ্বিতীয়ত, পতিত স্বৈারাচরের দোসরদের, যারা সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে বিদ্যমান রয়েছে, তাদের অসহযোগিতায় সরকার পদে পদে বাধাগ্রস্ত ও বিব্রত হচ্ছে বলে আমাদেও ধারণা। পাশাপাশি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষ নিয়ে ভারত সরকার অন্তর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এসব কারণ ছাড়াও আরো নানান কারণ রয়েছে, যার মধ্যে সরকারের কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে অপারগতা এবং কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার কথা উল্লেখ করা যায়। অনেকের মতে, সরকার ব্যর্থতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ, সরকার সর্বোতভাবে সফল হোক, এটাই দেশের মানুষ ও রাজনৈতিক দলসমূহের কামনা। কারণ, সরকার ব্যর্থ হলে আমরা সবাই ব্যর্থ হবো। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, অভ্যুত্থান, রক্তদান, অঙ্গদান সবকিছু ব্যর্থ হবে। সরকার ব্যর্থ হওয়া মানে ছাত্র-জনতার আন্দোলন-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা অপূর্ণ থাকা এবং স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হাওয়া, যা কারো কস্মিনকালেই কাম্য হতে পারে না। অতএব, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হতে হবে। তাকে সফল করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সকলকেই সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা করতে হবে। সরকারেরও সফল হওয়ার প্রতিজ্ঞা থাকতে হবে, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে আগ্রধিকার নির্বাচন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা, সমন্বয়হীনতা পরিহার ইত্যাদি করতে হবে। সবক্ষেত্রে সততা, জবাবদিহি, উদ্যম, সৃজনশীলতা ও কর্মতৎপরতার পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই সরকারের প্রকৃতি অন্তর্বর্তীকালীন। অর্থাৎ সাময়িক সরকার। একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত এ সরকার দায়িত্ব পালন করবে। এ সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এজন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেহেতু পতিত স্বৈরাচারী সরকার সরকারের যাবতীয় অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বিনাশ ও অকার্যকর করে গেছে, সুতরাং সেগুলো সংস্কার ও কর্মক্ষম করা সরকারের দায়িত্বের অন্তর্গত। ইতোমধ্যে সরকারের তরফে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। কতদিনে সংস্কার শেষ হবে, বলার উপায় নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যথা শিগগিরই সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেয়া হবে। সরকারের কথা অনুযায়ী, নির্বাচন আটকে থাকছে সংস্কারের ওপর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতে, সংস্কারের জন্য যত সময় লাগুক, দিতে হবে। ওদিকে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ ও মতানৈক্যের আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে, যা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। এমতাবস্থায়, সরকারের উচিত হবে যতটা প্রয়োজন সংস্কার দ্রুত করা এবং নির্বাচন দেয়া। আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্রাইসিস গ্রুপ এক প্রতিবেদনে বলেছে, নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ১৮ মাসের বেশি সময় নেয়া উচিত হবে না। সংস্কারের প্রসঙ্গে বলেছে, সংস্কার এগিয়ে নিতে সরকারকে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। ওদিকে দ্য ইকোনমিস্ট তার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইউনূস সরকারের উচিত নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের টাইম ফ্রেম ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়েছে। আমরা আশা করবো, সার্বিক দিক বিবেচনা করে সরকার দ্রুত নির্বাচনের সময় ঘোষণা করবে।