এমরান চৌধুরী
উপর্যুক্ত শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা আছে ভারতীয় কবি দীপ্তি রায়ের। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। পারিবারিক কলহ বিবাদ নিয়ে লিখতে গিয়ে কবিতাটি চোখে পড়ে। আমার ধারণা ছিল এটা একটি প্রবাদ বা খনার বচন। যা-ই হোক কবিতার এই লাইনটি আগে গ্রাম বাংলার বাড়িঘরের বারান্দায় সাদা কাপড়ের উপর সুন্দর সূচিকর্ম করে আয়না বাঁধাই করে রাখা হতো। এখন এই প্রবাদবাক্যের মতো পাঠকপ্রিয় পঙক্তি কারো বারান্দায় কিংবা ড্রইংরুমে শোভা পায় না।
কবিতার লাইনটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায় তাহলো সংসারকে মিষ্টাঙ্গন বানানোর দায়িত্ব একমাত্র রমণী তথা গৃহবধূরই। আবার আর একজন কবি সংসারকে সমরাঙ্গন বলেছেন। এখন এই সমরাঙ্গনকে হঠাৎ করে আরেক ঘরের, ভিন্ন রক্তের, ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠা আরেক মা-বাবার আদুরে মেয়ে কীভাবে সুখী গৃহকোণ বানাবেন আমাদের বোধগম্য নয়। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এখানে রমণী বলতে পুত্রবধূকে যদি ইঙ্গিত করা হয় তা সুবিবেচনা প্রসূত নয়। কেননা অন্য ঘরে জন্ম, বেড়ে উঠা, আচার আচরণে অভ্যস্ত একজন মেয়ে মানুষ কীভাবে আরেকটি ঘরকে আলোকিত করবে তা রীতিমতো গবেষণা বিষয়।
লক্ষ্য করুন, সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে বাক্যটা কতটা যুক্তিসঙ্গত ? গুন শব্দটি পদ বিভাজনে বিশেষ্য পদ। শব্দটি অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়। দ্রব্যের গুন, শিক্ষার গুন, ঔষধের গুন। আর ব্যক্তির বেলায় কারো মন জয় করার গুণ। গুণ শব্দটি বিশ্লেষণে দেখা যায় কোনো রমণী সংসার সুখময় করতে তার মধ্যে থাকতে হবে কতিপয় গুণাবলি। কী ধরনের গুণ থাকলে একজন রমণী সংসার নামক সমরাঙ্গনকে মিষ্টাঙ্গন করে গড়ে তুলতে পারেন কবির ভাষায় তা হলো –
রমণী যদ্যপি হয়, গুনের আধার,
সুখ শান্তি জীবনধরি বাঁধা থাকে তার।
পুঁথি পড়ে বিদ্যার নাহি প্রয়োজন,
যদি নাহি জানে সে, আচার আচরণ!
সুখ, শান্তি, আচরণ নিয়ম পালন রমণীরই কর্ম,
সংসার রক্ষিত পারে, যারা পালন করে এই ধর্ম!
সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে
আবার সংসার নষ্ট হয় রমণীর কারণে।
কবি রমণীর গুণের যে সব কথা উল্লেখ করেছের তা একজন রক্ত মাংসের মানুষের মধ্যে পরিপূর্ণ থাকার কথা নয়। যেমন কবি বলেছেন তাকে গুনের আধার হতে হয়। আবার এ-ও বলেছেন উচ্চ শিক্ষিত হলে কথিত গুনের আধার হবে এমন কোনো কথা নয়। রমণীর আচার আচরণ যদি পরিবার বা সমাজের অনুক‚লে না যায় তাহলে লেখাপড়া থাকলে বা শিক্ষিত হলে কী হবে? কবির মতে সুখ, শান্তি নির্ভর করে রমণীর আচার আচরণ এর উপর। যার আচার আচরণ সংসারের সদস্যদের মন যোগাতে পারে সেই রমণীই হতে পারেন সুখের সংসারের স্রস্টা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে একজন রমণীর পক্ষে পরিবারের সবার মন যোগানো সম্ভব নয়। সে উচ্চশিক্ষিত হলে এই সম্ভাবনা ৭০% কমে যায়। অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত, গরিব পরিবারের মেয়েরা যতটা ধর্ম ভীরু, স্বামীভক্ত, শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি অনুরক্ত, দেবর-ননদের প্রতি স্নেহশীল, সংসারের কাজকর্মে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে থাকে। এসব পরিবারের রমণীরা অনেক ক্ষেত্রে সংসারকে সুখী করে গড়ে তুলতে পারে। তবে এ সংখ্যাও হাতে গোণা।
তবে সংসার সুখের করতে হলে রমণীর ভূমিকার সাথে সাথে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ সবার ভূমিকা থাকার দাবি রাখে। এদের একজনের যে কোনো নেতিবাচক কর্মকাÐ সংসার সুখের অঙ্গন না হয়ে কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ধরুন স্বামীর রুজি-রোজগার সুবিধার নয়। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অর্থনৈতিক টানাপোড়নের কারণে সুখের চাবিটি আঁচলে নাও থাকতে পারে। অনেক বলে থাকেন পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকলে অর্থাভাব বড় কোনো সমস্যা নয়। আরে বাবা! অভাব যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, গরু তখন ছাগল হয়ে যায়। রমণীর কারণে সংসার তখনই সুখের হবে যখন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, পরিবারের সদস্যরা গৃহকর্ত্রীকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে দেন। লবণটা বেশি, মরিচটা কম, চায়ে চিনি বেশি বা কম এমন প্রশ্ন না তুলে চুপচাপ সুবোধ বালকের মতো খেয়ে হাসি মুখে বলতে পারেন বউমা বেশ হয়েছে । এক্ষেত্রে বলা যায় সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে।
প্রকৃত অর্থে কোনো রমণীর দ্বারাই সংসার সুখের হয় নয়। এরজন্য বড় ধরনের ত্যাগ থাকে স্বামী বেচারার। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে স্ত্রী-কে সুখের আধার বানিয়ে মা-বাবাকে খুশি করতে চান। স্বামী যদি বোবার ভূমিকায় থাকেন।
শ্বশুর-শাশুড়ি যদি নিজ মেয়ের মতো পুত্রবধূর সাত খুন মাফ করতে পারেন, স্বামী যদি তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে যথাযথ সম্মান সহকারে আপ্যায়ন করতে পারেন তবে সাময়িকভাবে হলেও রমণী সংক্রান্ত বহুল পঠিত, চর্চিত প্রবাদবাক্যটি সঠিক হতে পারে, অন্যথায় নয়।
একসময় গ্রামে-গঞ্জে একান্নবর্তী পরিবার ছিল। নগরায়নের ফলে সদ্যবিবাহিত মেয়েটিও এখন শহরমুখী হতে চায়। স্বামী যদি মা-বাবাকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রেখে শহরমুখি হতে না চায় তখন শুরু হয় নানা তালবাহনা। মান অভিমান, হাঙ্গার স্টাইক আরও কত নাটকের অবতারনা করা হয়। সমরাঙ্গনে হার হয় স্বামীর। কারণ জুদা ভাত উদা মজা। ফলে নদীর পাড় ভাঙ্গার চেয়ে দ্রুত গতিতে ছোট ছোট পরিবার গড়ে উঠছে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ভাষায় এরাই সুখি পরিবার। আসলে সুখি পরিবার হলো সেই পরিবার যেখানে স্বামী ভেড়ার মতো সব কিছু মানিয়ে নেয়। তরকারিতে লবণ বেশি হলেও টু শব্দটি করে না। সংসার জীবনে একজন পুরুষ যতটা ত্যাগ করে কোনো রমণী তার সিকি ভাগও করে না। তবে এ কথা ঠিক যে কোনো রমণী যদি একবার জুদা খাওয়ার চিন্তা করে কিংবা শহরে বাসা নেওয়ার স্বপ্ন দেখে তাহলে সে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। রমণী এই যুদ্ধে জয়ী হলেও সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে এর চেয়ে অর্থহীন বাক্য পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক