জসিম উদ্দিন মনছুরি
দেশ পরিচালনার নিয়ম নীতিকে সংবিধান বলা হয়। জনগণের কল্যাণে সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানে দেশের জনগণের মতামতের প্রতিফলন হয়। জনগণের চাওয়া পাওয়ার ভিত্তিতে আইন প্রণেতারা জনগণের জন্য সংবিধান রচনা করেন। প্রতিটি দেশে দেশ পরিচালনার জন্য সংবিধান রচনা করা হয়। উত্তম সংবিধান হলো লিখিত সংবিধান। যা হবে সংক্ষিপ্ত। যে সংবিধান জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। সংবিধান ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা করা অসম্ভব। সংবিধান হতে হবে জনমতের ও জন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। পৃথিবীর মানচিত্রে যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয় তখন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে সংবিধানে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। সংবিধানের দোহাই দিয়ে দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করার জন্য সংবিধানকে কুক্ষিগত করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলো। নবগঠিত রাষ্ট্রে তার শাসনামলকে অনেকে ফেরাউনের শাসন আমলের সাথে তুলনা করে থাকেন। সীমাহীন দুর্নীতি, জুলুম, নির্যাতন অর্থআত্মসাৎ অর্থপাচার, ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিলো দেশ। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে তিনি বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার সীমাহীন দুর্নীতি জুলুম, নির্যাতনে বাংলাদেশ কারাগার তুল্য হয়ে গিয়েছিলো। বিরোধী মতকে কণ্ঠরুদ্ধ করায় তৎকালীন কিছু সেনা বিদ্রোহে শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নিহত হন। শেখ মুজিবের জানাজায় মুষ্টিমেয় লোকজনের উপস্থিতি তার প্রতি জনগণের ক্ষোভের পরিমাণ অনুমিত হয়। তার মৃত্যুতে লক্ষ লক্ষ জনগণ খুশিতে আত্মহারা হয়ে রাস্তায় নেমে মিছিল করেছিলো। তা থেকে বুঝা যায় শেখ মুজিবের শাসনব্যবস্থার নমুনা। তিনিই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের বীজ বুনন করেছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সরকার নিজেদের স্বার্থে সংবিধান সংস্কার করেছেন। এই পর্যন্ত সংবিধানে সপ্তদশ সংশোধনী আনা হয়েছে। প্রতিটি সরকারই জনগণের কথা চিন্তা না করে নিজেদের স্বার্থে সংবিধান সংযোজন ও বিয়োজন করতে থাকেন। সংবিধানকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার ফলে দেশের সিংহভাগ জনগণের সংবিধান হয়ে ওঠেনি। বারবার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবার জন্য কোন সরকারই সংবিধান সংস্কার করেনি। ফলে সংবিধানে কিছু কিছু নেতিবাচক দিক রয়ে গেছে। সংবিধানে দেশের জনগণের সবার সমান অধিকারের কথা থাকলেও বিগত আওয়ামী ফ্যসিস্ট সরকার বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সুরক্ষা আইন সংবিধানে সন্নিবেশিত করায় সংবিধানে দ্বিমুখী নীতি পরিলক্ষিত হয়। সংবিধান সংস্কার করতে দুই তৃতীয়াংশ সংসদীয় ভোটের প্রয়োজন হয়। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য সংবিধানে বেশ কিছু সংযোজন বিয়োজন করেছে। ভোট বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে তারা বারবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সংবিধানকে নিজেদের স্বার্থে লিপিবদ্ধ ডায়েরির মতো করে রেখেছিলো। ফলে জনগণের চরম অসন্তোষ থাকা সত্বেও তারা জনগণের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নিজেদের মতো করে সংবিধান সংস্কার করেন। এই পর্যন্ত সপ্তদশ সংশোধনী আনা হলেও মূলত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে সংবিধান। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার হত্যা, গুম,নির্যাতন, দুর্নীতি ও অর্থলোপাটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অবর্ণনীয় ক্ষতি সাধন করে। তারা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নিজেদের অপকর্মকে আড়াল করার প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার না থাকায় জনগণ স্বাধীনদেশে পরাধীন হিসেবে বসবাস করে আসছিলো। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সীমাহীন জুলুম নির্যাতনে ষোল বছর পর ছাত্র-জনতার কঠোর আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতাচ্যূত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলে দেশের আপামর জনসাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে পায়। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার সংস্কারের অংশ হিসেবে সংবিধান সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করেন। ডক্টর আলী রিয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কারের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। আশার কথা হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিটি ব্যাপক গবেষণা করে বহির্বিশ্বের ৫০ টির মতো সংবিধান পর্যালোচনা করে একটি খসড়া অনুমোদন করেছেন। প্রস্তাবিত সংবিধানে বেশ কিছু পরিহার ও সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সুরক্ষা আইনটি বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। জন্মসূত্রে সবাই বাংলাদেশী নাগরিক হওয়া সত্বেও সংবিধানের দুইটি নীতি সংযোজন করা দেশের জনগণকে দ্বিধা বিভক্ত করার শামিল। একজন প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। দলীয় প্রধান ও সরকার প্রধান একসাথে থাকতে পারবেন না। বিরোধী দল থেকেই ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনায়ন করতে ক্ষমতার ভাগাভাগি করণ। প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা। এসব বিষয় যদি সংবিধানের সংযোজন করা হয় তাহলেই দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে বলে সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস। বিগত সরকার নিজেদের মনগড়া সংবিধান সংস্কার করে জনরোষে পরিণত হয়েছিলো। উন্নত দেশের সংবিধান হচ্ছে সংবিধান লিখিত থাকবে। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। এক দলের না হয়ে সংবিধান হবে সর্বদলীয়। দেশের সকল স্তরের জনগণের সংবিধান। কিন্তু বিগত আওয়ামী সরকার সংবিধানকে নিজেদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের মতো করে দেশ পরিচালনা করে গেছেন। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার যদি সত্যিকার অর্থে সংস্কার করতে চায়। তাহলে দেশের আপামর জনসাধারণ তাদের প্রতি সমর্থন দিবে।
কেননা স্বাধীনতাত্তোর বিগত ৫৪ বছরেও জনগণ নিজেদের অধিকারের কথা কিংবা বাকস্বাধীনতার কথা প্রকাশ্য বলতে পারেনি। একদল আরেক দলকে ঠেকানোর জন্য সংবিধানে সংস্কার আনা হয়েছে বারবার। স্বাধীন দেশের গণতন্ত্র হবে বহু দলীয়। এবং সংবিধান হবে প্রতিটি দলের। প্রতিটি মতের কিংবা প্রত্যেক জনগণের। সংবিধান জনগণের কথা বলবে। সরকারও জন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।গণতন্ত্র হবে উন্নত ও জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের অভিপ্রায়। এখন গণতন্ত্র বলতে জনগণ যেটা বুঝে তা হচ্ছে ক্ষমতায় আসার জন্য সংবিধানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। দেশের অনেক কিছুই সংস্কার করা প্রয়োজন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। প্রথমত বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ। স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিচার ব্যবস্থা। পুলিশ বাহিনীর সংস্কার। স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার অধিকার প্রদান করা। সংবিধান হবে জনগণের সংবিধান। যে সংবিধানে কোন বৈষম্য থাকবে না। সকল ধর্মের সকল জাতির সকল শ্রেণির মানুষের কথা সমভাবে উল্লেখ থাকবে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিগত ৫৪ বছরে সরকারে অধিষ্ঠিত প্রতিটি দল জনগণকে নিজেদের স্বার্থে জিম্মি করে রেখেছিলো। এখন সময় এসেছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। বাকস্বাধীনতা ফিরে পাবার। বৈষম্য দূরীকরণের। ঘুষ দুর্নীতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার। ক্ষমতা ফিরে পাবার। তখনই ২৪ এর বিপ্লব সার্থক হবে যদি দেশের সকল নাগরিক সম অধিকারে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতা ফিরে পায়। জনগণের প্রত্যাশা সংবিধান সংশোধন করে স্থায়ীভাবে একটি কাঠামো তৈরি হোক। যে কাঠামোতে জনগণকে আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বাকস্বাধীনতার জন্য রাস্তায় নামতে হবে না। সংবিধান থাকবে সমুন্নত। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলি ও বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ পৃথকীকরণের মাধ্যমে জনগণের ন্যায় সঙ্গত অধিকার ফিরে পাবার। সংবিধান সংশোধন হোক জনকল্যাণে, শুধুমাত্র জনগণের মত প্রতিফলনে।
লেখক : প্রাবন্ধিক