পূর্বদেশ ডেস্ক
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নির্বাচন নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা। অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে নির্বাচন দেবে, কতদিন সময় লাগবে, কীভাবে রাষ্ট্র সংস্কার করবে, এসব নিয়েও চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে সংবিধান নিয়ে। যেহেতু শেখ হাসিনার সরকার সংবিধান থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়টি বাদ দিয়েছে, তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও কেউ কেউ তুলছেন প্রশ্ন। এমন পরিস্থিতিতে সংবিধান পুনর্লিখন নাকি সংশোধন হবে, সেটি নিয়ে বিভিন্ন মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
গতকাল শনিবার ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ’ শীর্ষক আয়োজনে বিশিষ্টজনেরা তাদের মতামত দেন।
রাজধানীর রমনার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে এ সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। খবর বাংলানিউজের।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ’ শীর্ষক এই ধারাবাহিক সংলাপের প্রথম আয়োজনের বিষয় ছিল ‘সংবিধান’।
সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সিজিএস’র উপদেষ্টা ড. আলী রীয়াজ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারম্যান অ্যাড. জেড আই খান পান্না, নিউ এজ’র সম্পাদক নূরুল কবির, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রমুখ।
সংলাপে একজন আইনজীবী হিসেবে নিজের মতামত তুলে ধরে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেন, সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন, কোনটি হবে, সেটি আলোচনার মধ্য দিয়ে ঠিক হবে। তবে যেটিই হোক, সেটা আমাদের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দিকে নিয়ে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংবিধান প্রণয়নের পর সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন করা হয়েছে। সংবিধান একটি জীবিত নথি। এর স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি নিতে হয়। অনেকেই বলছেন, এই সরকারকে (অন্তর্বর্তী সরকার) সংবিধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। আমি বলব, সরকার সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকারী নয়। এই সরকার হচ্ছে ট্রাস্টি, সুবিধাভোগী হচ্ছে জনগণ এবং এই সরকারের বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সিজিএস’র উপদেষ্টা ড. আলী রীয়াজ বলেন, গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের সংবিধানের যে পরিবর্তিত রূপ দাঁড়িয়েছে, সেই পরিবর্তিত রূপ এখনকার জন্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে কিনা সেটাই হচ্ছে বড় প্রশ্ন। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করা দরকার। একই ব্যক্তি যেন সরকার, দল ও রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে না পড়েন। একজনের হাতে সমস্ত ক্ষমতা থাকার কারণে গত ১৫ বছরে দল এবং সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাইনি। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি কেন্দ্রিক একটি স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল।
সংবিধান সংস্কার হবে নাকি পুনর্গঠন হবে এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে সংশোধন শব্দটার পক্ষে নই। কারণ সংবিধানের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে ব্যান্ডেজ দিয়ে কোনো কাজ হবে না। এটা পুনর্লিখন ছাড়া কোনো উপায় নেই।
১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটে তৈরি করা সংবিধান দিয়ে এখনো চলা সম্ভব নয় বলে মনে করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারম্যান অ্যাড. জেড আই খান পান্না।
নিউ এজ’র সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, ক্ষমতা কখনো অসীম ও অনির্দিষ্ট নয়। গণতান্ত্রিক দেশে একমাত্র অসীম ক্ষমতা জনগণের। কারণ এই অসীমতাকে জনগণ ছোট ও বড় করতে পারে। তাই সংবিধান বিশেষজ্ঞরা সংবিধান প্রণয়ন বা সংশোধ করতে পারেন। কিন্তু সেখানে জনগণের সম্পৃক্ততা লাগবে। তা না হলে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান হতে পারে না।
সুজন’র সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সংবিধান নতুন করে পুনর্লিখন করতে হবে নাকি সংশোধন করেই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়া যাবে? এই প্রশ্নের সুরাহা যদি আমরা করতে পারি তাহলে অন্য সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে। আমার মনে হয়, এই সিদ্ধান্তটা প্রাথমিকভাবে আমাদের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, নতুন বাংলাদেশে আমাদের ওই জায়গায় পৌঁছাতে হবে, যেখানে আমাদের আগের যে রাজনৈতিক দর্শন রয়েছে, সেগুলোকে কীভাবে পুনর্গঠন করব। এই পুর্নগঠনের ভিত্তির ওপরেই নির্ধারণ হবে, কীভাবে আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে নতুন নতুন জায়গা থেকে পুনর্নির্মাণ করব।