সংঘাতের জন্য ‘সবাই মুখিয়ে’ আছে, কয়েক মাসের মধ্যেই দেখা যাবে : তথ্য উপদেষ্টা

4

পূর্বদেশ ডেস্ক

সবাই সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছে এবং কয়েক মাসের মধ্যে সেই সংঘাত দৃশ্যমান হবে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। আর সেই সংঘাতে যদি ‘ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ’ যুক্ত হয়, তাহলে দেশের পরিস্থিতি ‘আরও খারাপ’ হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ‘প্রত্যেকেরই আদর্শিক অবস্থান নেওয়ার নাগরিক অধিকার আছে। কিন্তু সেই অধিকার যখন আরেকজন ভঙ্গ করবে, তখন আসলে লড়াইটা অনিবার্য হয়। ফলে লড়াইয়ের আগে আমাদের ঐক্যের সুর তোলা উচিত।’ খবর বিডিনিউজের
প্রধান উপদেষ্টার ‘অবস্থানের কারণে’ এখন অনেকে সংঘাতে জড়াচ্ছেন না মন্তব্য করে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘সবাই সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছেন এবং আপনারা অবশ্যই এটা অল্প কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন। আমি আশঙ্কা করছি, যদি এটার সঙ্গে ধর্মীয় যে দৃষ্টিকোণ, এটা যদি যুক্ত হয়, তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’
গতকাল শনিবার রাজধানীর তোপখানা রোডের বিএমএ ভবনের ডা. শামসুল আলম খান মিলন সভাকক্ষে ‘মাজার সংস্কৃতি: সহিংসতা, সংকট ও ভবিষ্যৎ ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বক্তব্য দেন তথ্য উপদেষ্টা। এই সংলাপের আয়োজন করে ‘মাকাম: সেন্টার ফর সুফি হেরিটেজ’।
তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি শুনেছি আওয়ামী লীগ দরবারগুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার চেষ্টা করছে। দরবারগুলোকে এটা বোঝানোর জন্য যে, অধ্যাপক ইউনূসের সরকার এসে মাজার ভেঙে দিচ্ছে, মসজিদ থেকে বের করে দিচ্ছে। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইস্যু নয়। এটা ৫০ বছর ধরে চলছে। যখন সরকার পরিবর্তন হয়, মসজিদ কমিটি বদল হয়ে যায়। ইসলামী ফাউন্ডেশনের গভর্নিং কমিটি বদল হয়ে যায়।’
মাহফুজ আলম বলেন, মাজারসহ যত মতাদর্শ মানুষের বসবাস বাংলাদেশে রয়েছে, সব ধরনের মানুষের মধ্যে যদি সংলাপের সুযোগ না থাকে, তাহলে তা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ চলে গেলেও ‘সামাজিক ফ্যাসিবাদ’ এখনো রয়ে গেছে বলেও মনে করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আমাদেরকে এখন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশে যারা ইসলামের নামে রাজনীতির চর্চা করেন, তারা হাজার বছর ধরে ইসলামের যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে, তাতে ভ্রূক্ষেপ করেননি। সে কারণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক দলের সংশ্লেষও জড়িত। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক আলোচনার জায়গায় ধর্মকে বাদ দেওয়ার যে প্রকল্প, তাকে মোকাবেলা না করলে এই সংকট শিগগিরই কাটবে না। এখন গত এক বছর যাবৎ মাজার, দরবারের উপর যে হামলা হয়েছে তার যদি পাল্টা আঘাত হয় তাহলে তা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকে নস্যাৎ করবে। ফলে, এই সহিংসতাকে যেকোনো মূল্যেই হোক বন্ধ করতে হবে। সহিংসতা বন্ধ করার জন্য সামাজিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে; সামাজিক সংলাপের মাধ্যমেই এই সংকট দূরীভূত করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন মাহফুজ আলম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে মাজার ও দরবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থেই মাজার ও দরবারের প্রতি এই সহিংসতাকে রোধ করতে হবে। আমার পরামর্শ থাকবে, সুফি সমাজের পক্ষ থেকে এই আওয়াজ তোলা উচিত যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের ইশতেহারে যেন সুফি সমাজের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমাদের দেশে মাজার, দরবারের দায়িত্বশীল যারা আছেন, তাদের একটা ঘাটতি হলো, তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখতে পারছেন না। যে কারণে তাদের কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারছে না। সুফি সমাজের এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে আপনারা অবদান রাখতে পারবেন।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে মাজার, দরবারে যে সহিংসতা হলো, এ ঘটনাগুলোর তদন্ত ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করারও তাগিদ দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির এই নেতা। তিনি বলেন, দেশের নাগরিক কওমি হোক, আলিয়া হোক, সুন্নী হোক, যে যেই মতাদর্শ ধারণ করুক না কেন, কেউ কারো গায়ে আঘাত করব না। এই জায়গায় আমাদের একটি বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আয়াতুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ অলি আউলিয়ার দেশ। এখানে সকল ধর্মের, সকল মতের মানুষের পাশাপাশি বসবাস। আমরা চাই, জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সকল ধর্মের, সকল মতের মানুষ সহিংসতাকে মোকাবেলা করে পারস্পরিক স¤প্রীতি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করবেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘মাজার সংস্কৃতি: সহিংসতা, সংকট ও ভবিষ্যৎ ভাবনা’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মাজার সংস্কৃতি বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির একটি অংশ। বাংলাদেশের জনগণ, সমাজ ও সংস্কৃতিরই একটি অনুষঙ্গ। এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গটি ধারাবাহিক ও সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়ে বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে। কেবল সুফি সমাজ নয়, বরং বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ও তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের উপর এ আঘাত কেউই মেনে নিতে পারছেন না।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, সুফি-সমাজ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ সকলেই চলমান সহিংসতার সমাপ্তি চাইছেন এবং একটি সমাধানের পথ খুঁজছেন। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখতে এই সমাধান অত্যন্ত জরুরি। আয়োজকদের পক্ষ থেকে ৫ আগস্ট পরবর্তী সারাদেশে মাজারে সহিংসতা বিষয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। হামলার শিকার হওয়া শেরপুরের মুর্শিদপুর দরবারের প্রতিনিধি মাওলানা মতিউর রহমান বলেন, যে নাজেহাল পরিস্থিতির মধ্যে মুর্শিদপুর দরবারকে পড়তে হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। এই দরবারে মাজার নেই, সেজদা নেই, কোনো বিতর্কিত কর্মকান্ড নেই, তবুও কেন এই বর্বরোচিত হামলা হলো? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই।
গাজীপুর দরবারের প্রতিনিধি মুহা. রবিউল ইসলাম বলেন, মাজারে আক্রমণ মানে সমাজকে বিভক্ত করা। আমরা যদি চুপ থাকি, তাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এখনি সময় সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। মাজার কেবল ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং বাংলাদেশের ঐতিহ্য। সরকারকেই এর সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।
কবি রাফসান গালিব বলেন, কেন ৫ আগস্টের পর এত বেশি মাজারে হামলা হলো? এটা সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। একশ-দেড়শ ঘটনার পরেও কেন রাষ্ট্র ও সরকার থেকে দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ দেখা গেল না? সেইসঙ্গে আমাদের এ প্রশ্নও তুলতে হবে, আগে ধর্মীয় সমাজে যে মতাদর্শিক দ্ব›দ্ব বা বিরোধ শুধু বাহাসের মধ্যে চলমান ছিল, সেটি কেন সহিংস হয়ে উঠল, সেখানে কেন হামলা-ভাঙচুর–লুটপাট যুক্ত হলো? ধর্মীয় মতপার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়ে সবার মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার চর্চার যে ঐতিহ্য আমাদের সমাজে ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছিল, তা কেন নষ্ট হয়ে গেল, সেটির অনুসন্ধানও আমাদের করতে হবে।
আইনজীবী মানজুর আল মতিন বলেন, কোরআন এত সুন্দর, নির্মল, পবিত্র, অথচ কোরআনের নাম ধারণ করে অনেকে মাজার, দরবারে হামলা চালাচ্ছেন। এই সহিংসতার ফলে দেশের সমাজ ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এই বিপর্যয় রোধ করতে না পারলে বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে, যা কারো জন্যই কল্যাণকর নয়।
ইমরান হুসাইন তুষার এবং মিজানুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে সুফি সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।