ষাটের দশকের বিপ্লবী ছাত্রনেতা ছাবের আহমদ আসগরী

1

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

ষাটের দশকে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে পাহাড়তলী শাখাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংগঠনিক শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কারণ কেন্দ্র এবং শহর শাখা থেকে ঘোষিত সকল কর্মসূচি পাহাড়তলীতে যেভাবে সংগ্রামী চেতনায় সফল ও সার্থক করে তোলা হতো, শহরের অন্য কোন শাখায় সেভাবে হতো না। পাহাড়তলী আঞ্চলিক শাখা ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে একটি বলিষ্ঠতা, জঙ্গীরূপ প্রতিফলিত হতো। দুটি কারণে হয়তো পাহাড়তলী ছাত্রলীগ আপসহীন সংগ্রামী ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছিলো। একটি কারণ রেলওয়ে এবং আরেকটি কারণ অবাঙালি অধ্যুাষিত এলাকা। রেলওয়েতে প্রচুর শ্রমিক কর্মচারী কাজ করতো এবং তাদের একটি শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ছিলো। রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলন ছাত্র রাজনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করতো। ২য় কারণ হিসেবে আমি বিহারীদের প্রতি ইঙ্গিত করেছি। পাহাড়তলীতে বিপুলসংখ্যক বিহারী তথা আবাঙালি বসবাস করতো। তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দ্ব›দ্ব-সংঘাতের মধ্যে দিয়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হতো। বিহারীদের সঙ্গে বাঙালিদের বিরোধের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ। সেদিন পাহাড়তলীতে বিহারীরা সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছিলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিলো। কোন কোন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিজেরাই ছদ্মবেশে বিহারীদের সাথে মিশে বাঙালিদের উপর হামলায় অংশ নিয়েছিলো।বিহারীদের সাথে সংঘাতই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো।
পাহাড়তলী ছাত্রলীগ সবসময়ই একটি শক্তিশালী সংগঠন ছিলো। এই সংগঠন থেকে ছয়জন বিখ্যাত ছাত্রনেতা বেরিয়ে এসেছিলেন, যাঁরা পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম এবং জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তাঁরা হচ্ছেনÑফেরদৌস আহমদ কোরেশী ও তাঁর ছোট ভাই ছাবের আহমদ আসগরী, মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর ছোট ভাই ডা. মাহফুজুর রহমান, ওমর সাফায়াত কাওসার ও ফাহিম উদ্দিন। আরেকজনের নাম উল্লেখ করতে হয়, তিনিযদিও ছাত্রনেতা ছিলেন না, তথাপি তিনি ছাত্রলীগ নেতাদেরকে রাজনীতিতে উৎসাহিত করতেন। তিনি হচ্ছেন অধ্যাপক আজিজুল বারী। তিনি ছিলেন ফেরদৌস কোরেশীর বন্ধু, কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তবে রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তাঁর ছোট ভাই হেনা ইসলামও সেসময়ের উত্তপ্ত রাজনীতির অন্যতম উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। হেনা লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। ছাবের আহমদ আসগরী পাহাড়তলীর ফসল ঠিক, কিন্তু পাহাড়তলী ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তাঁর বিশেষ প্রভাব ছিলো না। পাহাড়তলী ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করতেন ডা. মাহফুজুর রহমান, ফাহিম উদ্দিন প্রমুখ।
ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতি এমএ মান্নান, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, শহীদ মুরিদুল আলম, আবু ছালেহ, আবদুর রউফ খালেদ, অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান, কফিল উদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ (পরে এডভোকেট), হারুনুর রশীদ (পরে অধ্যক্ষ), লোকমানুল মাহমুদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ ছাত্রনেতাদেরকে দিয়ে আরম্ভ হলেও ষাট দশকের শেষে এবং সত্তর দশকের প্রারম্ভে ছাত্রলীগে অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠেছিলেন ছাবের আহমদ আসগরী। এমন তুখোড় বক্তা, অসাধারণ সংগঠক, অক্লান্ত পরিশ্রমী ও সংগ্রামী নেতার সাক্ষাৎ ছাত্রলীগ আর পায়নি। শুধু তাঁর পূর্ববর্তী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইউসুফের সঙ্গেই তাঁর তুলনা হতে পারে। তবে এসএম ইউসুফের আরো গুণ ছিলো, যেমন তিনি ছিলেন বাগ্মী, অনলবর্ষী বক্তা, প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ নেতা। ছাবের আহমদ আসগরীকে তাঁর উত্তরসূরি বলা যেতে পারে। তবে দু’জনের নেতৃত্বের ধরণ ছিলো আলাদা।
ছাবের আহমদ আসগরী বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এমএ আজিজ। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগেরই অনুসারী ছাত্র সংগঠন। সেজন্য ছাবের আহমদ আসগরীকে এম এ আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ছাত্রলীগের কর্মকাÐ পরিচালনা করতে হতো। যে কোন প্রয়োজনে সাংগঠনিক সমস্যায় এমএ আজিজের পরামর্শ নিতে হতো। অফিসও ছিলো আন্দরকিল্লাহ একই বিল্ডিং-এ একই কক্ষে। এম এ আজিজও তাঁকে খুবই পছন্দ করতেন, ¯েœহ করতেন। এমএ আজিজ ৬৯ থেকে স্বাধীনতার কথা বলা শুরু করেন। ৬২ খ্রিস্টাব্দে সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমদ, আবদুর রাজ্জাক ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ‘নিউক্লিয়াস’ নামে যে গোপন রেজিমেন্টেড সংগঠন গড়ে তোলেন, এম এ আজিজ তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিউক্লিয়াসের পরামর্শদাতা ছিলেন। ছাবের আহমদ আসগরীও নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন। সুতরাং এমএ আজিজ যখন বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করার জন্য সাহসী বক্তব্য রাখছিলেন, ছাবের আহমদ আসগরীও তখন নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রলীগের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন করার কথা বলছিলেন। তখন কেন্দ্র থেকে নিউক্লিয়াসপন্থী ছাত্রনেতারা কিছু স্লোগান উদ্ভাবন করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামেও ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছাবের আহমদ আসগরী ছিলেন স্বাধীনতার বলিষ্ঠ প্রবক্তা। নিউক্লিয়াস সমর্থিত ছাত্রলীগের যে শাখাগুলি ছিলো সেখানে স্লোগান দেয়া হতো “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা”, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “বাঁশের লাঠি হাতে ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”-এরকম আরো নানা স্লোগানের মধ্য দিয়ে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করা হতো। তাছাড়া ছিলো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান; যা’ পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়েরও একটি জনপ্রিয় ধ্বনিতে পরিণত হয়েছিলো। ছাবের আহমদ আসগরী উত্তরে শুভপুর থেকে দক্ষিণে টেকনাফ এবং পূর্বে তিন পার্বত্য জেলা (তখন মহকুমা), খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান পর্যন্ত উল্কার মতো চষে বেড়িয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের সমান্তরাল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মী সৃষ্টি করেছেন। শহরে তোহা গাজী, ডা. মাহফুজুর রহমান, আ ই ম জাকারিয়া চৌধুরী, ডা. গোফরানুল হক, আগ্রাবাদের শফিউল্লাহ প্রমুখ পাহাড়তলী আমবাগান, হালিশহর, আগ্রাবাদ, মাদারবাড়ি, নন্দনকানন এলাকা এবং কমার্স কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও পলিটেকনিকে স্বাধীনতাপন্থী ছাত্রলীগের দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন।
চট্টগ্রাম কলেজে পুরোপুরি না হলেও শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, এবিএম নিজামুল হক, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, কাজী মনিরুজ্জামান মণ্টু, ইমামুল ইসলাম লতিফি প্রমুখ ছাত্রনেতার শক্তিশালী অবস্থান ছিলো। স্বাধীনতার পূর্বে ছাবের আহমদ আসগরী স্বাধীনতাপন্থী ছাত্রলীগের যে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীনতার পর যখন নিউক্লিয়াসের দুই শীর্ষ নেতা সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমদ এবং স্বাধীনতাপন্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মনিরুল ইসলাম, আ.স.ম আবদুর রব, নুরে আলম জিকু, শাহজাহান সিরাজ, আ.ফ.ম মাহবুবুল হক, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামক নতুন একটি দল গঠন করলেন, তখন চট্টগ্রামে সে দল গঠনের ভার এসে পড়েছিলো ছাবের আহমদ আসগরীর ওপর। তাঁর সঙ্গে আরো ছিলেন সিনিয়র এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, এমএ আজিজের পুত্র অধ্যাপক নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু, মোখতার আহমদ, আহমদ শরীফ মনীর প্রমুখ। কিন্তু এম এ আজিজের আওয়ামী লীগ এবংছাবের আহমদ আসগরীরছাত্রলীগের কাঠামোগত সহায়তা না পেলে চট্টগ্রামে জাসদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা সহজ হতো না। ফেব্রুয়ারি/মার্চ-এ ছাত্রলীগের মাঝে আদর্শিক ও নেতৃত্ব প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্তি পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। ছাবের আহমদ আসগরী প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সমগ্র চট্টগ্রামে টেকনাফ থেকে কবেরহাট পর্যন্ত ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ৭২-এর ফেব্রæয়ারির শেষ সপ্তাহে চার ছাত্রনেতা যথাক্রমে নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন চট্টগ্রামের উত্তর প্রান্ত থেকে সর্ব দক্ষিণে টেকনাফ পর্যন্ত ছাত্র জনসভা ও জনসংযোগ করেন। এই ব্যাপক জনসংযোগের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম ছাবের আহমদ আসগরী অত্যন্ত দক্ষতার সফলভাবে সম্পন্ন করেন। এই সফরের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ভবিষ্যতের মেরুকরণ তথা সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ও মুজিববাদপন্থী রাজনীতির বিভক্তি ফুটে উঠে। ছাবের আহমদ আসগরী তাঁর সহকর্মীবৃন্দ বিশেষ করে ইমামুল ইসলাম লতিফি ওগোফরানুল হক (ডা.) সহ আঞ্চলিক ছাত্রনেতাদের সাথে সাংগঠনিক মতবিনিময় কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই-এর শেষভাগে ২২/২৩ জুলাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দ্বিবাবিভক্ত হয়। চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগ তখন পুরোপুরিভাবে আবু মোহাম্মদ হাশেম ও ছাবের আহমদ আসগরীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চেতনার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এরই পরবর্তী সময়ে অক্টোবর মাসে জাসদের আত্মপ্রকাশ ঘটলে ছাবের আহমদ আসগরী জাসদের যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুগ্ম আহবায়ক হলেও তিনিই ছিলেন মূল ব্যক্তি এবং সমগ্র চট্টগ্রামে তিনি যে ঝটিকা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সফরে বের হন, তারই ফলে জাসদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চট্টগ্রামে সংগঠিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ছাবের আহমদ আসগরী যে তেজ, দৃঢ়তা এবং সংকল্প নিয়ে চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতিতে আবিভর্‚ত হয়েছিলেন, তাঁর পরিবার থেকেই তিনি তা পেয়েছিলেন। পাহাড়তলী রেলওয়ে হাইস্কুলের হেড মৌলভীর পরিবার থেকে দু’জন অসাধারণ রাজনৈতিক নেতার উদ্ভব সত্যিই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রথমে ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, ছাত্র রাজনীতির কালে দার্শনিক ছাত্রনেতা হিসেবে যিনি সকলের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন এবং উত্তরকালে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও জাতীয় নেতা হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন; কিছুদিন পরতাঁকেই অনুসরণ করে তাঁরই ছোট ভাই ছাবের আহমদ আসগরী ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আবিভর্‚ত হয়ে চট্টগ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। ফেরদৌস কোরেশী যেমন তাঁর সময়ে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তেমনি তাঁর ভাই ছাবের আসগরীও তাঁর সময়ে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে উন্নীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। জ্ঞানে, মেধায় ফেরদৌস কোরেশী অনেক অগ্রসর নেতা হলেও সাংগঠনিক দক্ষতায়, কর্মনিষ্ঠায় ছাবের আসগরী সমসাময়িক অন্যান্য সকল ছাত্রনেতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন।
ছাবের আহমদ আসগরীর জন্ম ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতা মৌলভী মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান অধ্যয়নের জন্য চট্টগ্রামে আসেন। দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে উলা এবং আই আই কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। তিনি ঈদগাহতে জায়গির নেন। সেখানে মক্তবে পড়াতেন, ইমামতিও করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। তখন তিনি পাহাড়তলী রেলওয়ে হাইস্কুলের হেড মৌলভী ছিলেন।
ছাবের আহমদ আসগরী পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুলে পড়াশোনা করেন। অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে ওঠার সময় ১৯৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে রেলশ্রমিক ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়, সে ধর্মঘটে পাহাড়তলী ইস্পাহানি মার্শালের শ্রমিকেরা অংশগ্রহণ করে। রেলওয়ে স্কুলের ছাত্ররা রেলশ্রমিকদের উক্ত ধর্মঘটে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে। তখন যেসব মিছিল হতো তাতে স্কুলের ছাত্ররা শ্রমিকদের সহযোগীর ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতো। এই ধর্মঘটের কাজ করতে গিয়ে ছাবের আহমদ আসগরী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। রেল এলাকার যত ছাত্র বিভিন্ন কলেজে পড়াশোনা করত, ধর্মঘটে তাদের সক্রিয় ভ‚মিকা ছিল। ফেরদৌস কোরেশী, প্রফেসর আজিজুল বারী ছাত্রদের নেতৃত্ব দেন। ওবায়েদ নামে একজন নেতা ছিলেন। তিনি খুব সম্ভবত জেলা ছাত্রলীগের প্যানেলে কোন এক সময় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছাবের আহমদ আসগরীকে মিটিং মিছিলে নিয়ে যেতেন। ১৯৬৪- ৬৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে আরেকটা রেল ধর্মঘট হয়, সারা পাকিস্তানব্যাপী এ ধর্মঘট হয়। মাহবুবুল হক তখন ইপরেল এর সভাপতি। তিনি পাকিস্তান রেলওয়ে শ্রমিক লীগেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং দৈনিক পূর্বদেশ-এর সম্পাদক ছিলেন। অয়্যারলেস কলোনিতে একটি পাউরুটি বিস্কুটের দোকানের পেছনে পোস্টার লেখা হতো। জেলা ছাত্রলীগের অনেক পোস্টারও সেখানে লেখা হতো। মাহবুবুল হক একদিন ছাবের আহমদ আসগরীকে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমাকে ইংরেজিতে পোস্টার লিখতে হবে। ওবায়দুল হক তাঁকে দিয়ে উর্দুতেও পোস্টার লেখান। মাহবুবুল হক সাহেব তাঁকে বলতেন তুমি প্রতিদিন দুটি ইংরেজি পত্রিকা পড়বে। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর ছাবের আসগরী ব্যাপকভাবে পোস্টার লিখতে থাকেন। সায়েন্সের ছাত্র ছিলেন। পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষার সময় হলে ঘুমিয়ে পড়েন। একটি কি দুটি আনসার করেন। ফিজিক্সে ১২ নম্বর পান। তবে জেনারেল ও ইলেকটিভ ম্যাথমেটিক্সসহ চার পাঁচটি বিষয়ে লেটার পান। মাহবুবুল হক তাঁকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, আমি তো রেফার্ড। তিনি কতগুলি বই পড়তে দেন। ইতিহাসমূলক বই, দু’তিনটি ইংরেজি বইও ছিলো।
(বাকী অংশ আগামী সংখ্যা)
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

 

একবার এনডিএফ-এর মিটিং ছিলো মুসলিম হলে। পাহাড়তলী শ্রমিক লীগের মিছিল যাচ্ছিলো সেই মিটিং-এ। ওবায়দুল হকের নেতৃত্বে তারা পাহাড়তলী এলাকার সকল ছাত্রলীগ কর্মী উক্ত মিটিংয়ে যোগদান করেন।
৬২ খ্রিস্টাব্দে মার্শাল ল’ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার ছিলো রেলওয়ে হাইস্কুল। সারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম মার্শাল ল’ বিরোধী মিছিল হয় চট্টগ্রামে। ৬২ খ্রিস্টাব্দে ছাবের আহমদ আসগরী অষ্টম বা নবম শ্রেণিতে পড়েন। ঢাকার শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে.এম ওবায়দুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, চট্টগ্রামের ফেরদৌস কোরেশী, এম.এ মান্নান, মুরিদুল আলম, ওবায়দুল হক পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুল ও গির্জাস্কুলের পেছনে যেখানে একটি গোল টাঙ্কি আছে, তারও পেছনে ফয়’স লেকের সম্মুখস্থ চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রধান পানি শোধনাগার এবং সংরক্ষণাগার এর মধ্যখানে চতুর্দিকে পাহাড়ের থলিতে লেকের পাড়ে সন্ধ্যার পরে এক গোপন মিটিং -এ বসেন। বর্তমান ইউএসটিসির পেছনে ট্যাঙ্কের লেকের ধারে চতুর্দিকে পাহাড় বেষ্টিত এই স্থান। ঐ মিটিংয়ে মার্শাল ল’ ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ছাত্রলীগের পরবর্তী কার্যক্রম (তখনো গোপন) নির্ধারিত হয়।ছাবের আহমদ আসগরী আমাকে এই তথ্য দেন এবং তা যদি সত্য হয়, তাহলে চট্টগ্রাম থেকে আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিলো বলা যায়। ড. মোহাম্মদ হান্নান বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস নামক যে গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাতে এই তথ্য নেই। এ যাবৎ আমরা জেনে এসেছি ঢাকায় সর্বদলীয় ছাত্রনেতারা আইয়ুবের সামরিক আইন ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন এবং ঢাকাতেই প্রথমসামরিক আইন ভঙ্গ হয়। কিন্তু ছাবের আহমদ আসগরীর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা চট্টগ্রামেই বৈঠক করে সামরিক আইন ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন। ছাবের আহমদ আসগরী আমাকে আরো বলেন, তিনি ছাত্রনেতাদের জন্য ওয়ার্কশপ গেট ক্যান্টিন থেকে কেটলিতে করে বৈঠকস্থলে চা বিস্কুট নিয়ে যান।
এই মিটিংয়ের পর কিছুদিনের মধ্যে মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নামে মার্শাল ল’ বিরোধী বড় ধরনের মিছিল বের হয়। রেলওয়ে স্কুল থেকে ভালোভাবে মিছিল বের হয়। পাঞ্জাবী লেন (শহীদ লেন) গার্লস হাইস্কুলের মেয়েদেরকে সেই মিছিলের সামনে দেয়া হয়। মিছিলের মূল সংগঠক ছিলেন ওবায়দুল হক, আশরাফ খান, মীরা (পরবর্তীকালে আশরাফ খানের স্ত্রী ও স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী), ইউনুস নূর, ইউনুস খান (পরবর্তীকালে পাহাড়তলী আঞ্চলিক ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক)। ছাবের আহমদ আসগরীও মিছিলে ছিলেন। মিছিলটি টাইগারপাস মামা ভাগিনার দরগাহ ক্রসিংয়ে পৌঁছার পর পাকবাহিনী রাস্তায় লালগালিচা বিছিয়ে দেয়। তার ওপর উঠলে গুলি করা হবে বলে হুমকি দেয়। কিন্তু বুদ্ধি করে ছোট বয়সের মেয়েদের সামনে দিয়ে মিছিল লাল গালিচা অতিক্রম করে যায়। পাকবাহিনী ইতস্তত করে গুলি করা থেকে বিরত থাকে। আমবাগান থেকে দুই লাইনের শৃঙ্খলিত মিছিল ছিল। মিছিলে প্রধানত রেলওয়ে হাইস্কুল, পাঞ্জাবী লেন গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ছিল। মিছিল স্টেশন রোড দিয়ে যাওয়ার সময় রেলওয়ের ব্রিজের ওপর দিয়ে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা যোগদান করে। নুরুন্নবী চৌধুরীর নেতৃত্বে মিউনিসিপাল হাইস্কুলের ছাত্ররা এখানে মিছিলে যোগদান করে। স্টেশন রোডে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে।
ছাবের আহমদ আসগরী ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পলিটেকনিকে ভর্তি হন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পরীক্ষার সময় গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। ১১ মাস জেলে ছিলেন। প্র্যাকটিক্যাল থাকাতে জেল থেকে পরীক্ষা দিতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা লাভ করেন।
ছাবের আহমদ আসগরী কাজী আবু জাফর ও অধ্যাপক নাজিম উদ্দিনের প্যানেলে জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। মোখতার আহমদ ও এসএম ইউসুফ যেবার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, সেবার তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও নির্বাচিত হন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে সিটি কমিটি জেলা স্ট্যাটাস পায়। ৬৯-এর গণআন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম মূল সমন্বয়ক ছিলেন ছাবের আহমদ আসগরী। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, এনএসএফ ও ছাত্রশক্তি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ৭০ খ্রিস্টাব্দে ছাবের আহমদ আসগরী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আবু মোহাম্মদ হাশেম (অ্যাডভোকেট) হনসভাপতি। ৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ৭ মার্চের পর কাজী আরেফ আহমদ তাঁকে বলেন, চট্টগ্রামের যেখানে যেখানে সম্ভব ট্রেনিং সেন্টার করার জন্য। দেশে টিকে থাকা সম্ভব না হলে সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে। তারা অস্ত্র সংগ্রহের জন্য আন্দরকিল্লার একটি বন্দুকের দোকান লুট করেন। ডা. মাহফুজুর রহমান ও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন সেটি লুট করেন।
ছাবের আহমদ আসগরী নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রামে নিউক্লিয়াসের সমন্বয়ক ছিলেন আবুল কালাম আজাদ।নিউক্লিয়াসের সদস্যরা কেউ কাউকে চিনতেন না। ধরা পড়লেও বলা সম্ভব ছিলো না কে কে আছে নিউক্লিয়াসে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ছাবের আহমদ আসগরী তাঁর বন্ধু এবং ছাত্রলীগ নেতা ডা. মাহফুজুর রহমানের সহায়তায় মেডিক্যালে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করেন। ২৩ মার্চ পর্যন্ত কাজী আরেফ বলেন, তোমরা তৈরি থেকো, শেখ মুজিব চট্টগ্রাম যাবেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক চট্টগ্রামের সন্তান স্বপন চৌধুরী, যিনি ছাত্রলীগের কার্যকরী কমিটির সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ-এর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসেন ২৪ মার্চ। তিনিও একই কথা বলেন। তিনি খামবন্ধ একটি চিঠি নিয়ে আসেন আবুল কালাম আজাদের জন্য; বললেন আপনাদেরকে যা বলবেন কালাম ভাই বলবেন। কিন্তু আবুল কালাম আজাদকে পাওয়া গেল না।তিনি তখন গ্রামে চলে গেছেন, হাশিমপুরে তাঁর বাড়িতে। চিঠি খোলার অনুমতি ছিলো না। তাই আবুল কালাম আজাদকে চিঠি দেওয়ারজন্য ছাবের আহমদ আসগরী ও স্বপন চৌধুরী ২৭/২৮ মার্চ দোহাজারী যান। ছাবের আহমদ আসগরী গাড়ি ড্রাইভ করেন। মানজার এন্ড কোং-র মানজার সাহেব ২২/২৩ তারিখ তাঁকে ঐ গাড়িটি দেন। ডাইহাটসু পিক আপ। পলোগ্রাউন্ডে গিয়ে ছাবের আহমদ আসগরী গাড়ি চালনা প্র্যাকটিস করেন। ছাবের আহমদ আসগরী আগে থেকে কিছু ড্রাইভিং জানতেন। দোহাজারী গিয়ে আবুল কালাম আজাদকেনা পেয়ে ছাত্রনেতা আবু তাহের খান খসরুকে (৭৫-এ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধৃত হয়ে নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন)। চিঠিটি দেওয়া হয়আবুল কালাম আজাদকে পৌঁছে দেয়ার জন্য।
কথা ছিলো আ স ম আবদুর রব চাঁদপুর হয়ে আগরতলা যাবেন। নোয়াখালীর মোস্তাফিজুররহমানের জন্য একটা মেসেজ ছিলো। ফেনী হয়ে আগরতলা যাবার পথে মোস্তাফিজুর রহমানকে মেসেজটি দিতে হবে। মেসেজটি স্বপন চৌধুরীর হাতে ছিলো। দোহাজারী থেকে আসার সময় কালুরঘাট সেতু পার হবার পর কাপ্তাই রাস্তার মাথায় এসেতাঁরা দেখেন প্রচÐ গোলাগুলি হচ্ছে। রাস্তাঘাট জনশূন্য। কিছু লোক ইতস্তত ছুটাছুটি করছে। তারা কাপ্তাই রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে দেন। সে সময় লেভেল ক্রসিং-এর গেট বন্ধ ছিলো। তারা গেটের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেন। তাদের গাড়িতে পেছন থেকে গুলি লাগে। মদুনাঘাট ব্রিজ পার হওয়ার পর তাদের গাড়ির চাকা ফেটে যায়। এক্সটা চাকা লাগান। পাহাড়তলী মহামুনিতে চাকা ভাল করে পরীক্ষা করেন রিক্সার গ্যারেজে। তখন বেলা ১২টা/ ১টা। চন্দ্রঘোনা লিচু বাগানে গিয়েও কোনো চাকা পেলেন না। কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের স্টোর থেকে দুটি চাকা নেন। শাহ আলম বীরোত্তমের পরিবারকে কাপ্তাই থেকে তুলে নেন। যাবার সময় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একটা চিরক‚ট দিয়ে যান। একরামের উদ্দেশে লেখেন কালুরঘাট পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে। ইমিডিয়েটলি ভেকেট করো। শহর ত্যাগ করার সময় তারা বিভিন্ন জায়গায় মেসেজ দিয়ে যান যে যেদিকে পারো রামগড় চলে এসো। আসার সময় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চেক করে দেখেন কেউ আছে কিনা। আবার একটি চিরকুট দেন তাড়াতাড়ি কলেজ ত্যাগ করার জন্য। একরাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভিপি অথবা জিএস ছিলেন। শাহ আলমের পরিবারকে নাজিরহাট নামিয়ে দিয়ে তারা রামগড়ে যান। শাহ আলম তাদের সাথে রামগড় যান। হাটহাজারীতে তাঁরা ডা. মাহফুজ, ফাহিম উদ্দিনসহ পাহাড়তলীর অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে দেখতে পান। তারা ভাটিয়ারি দিয়ে পাহাড়তলী থেকে হাটহাজারী আসেন। হাটহাজারীর ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আমিন তাদেরকে গেঞ্জি কিনে দেন। রামগড়ে হান্নান সাহেবসহ সকলের সাথে দেখা হয়।
এপ্রিলের ১ম সপ্তাহ হতে মুক্তিকামী জনতা রামগড়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করে। ছাবের আহমদ আসগরী রামগড় থেকে মিরসরাইয়ের প্রত্যন্ত প্রান্তরে গিয়ে নিজের পিকআপে করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে রামগড় এনে জড়ো করেন।
রামগড়ে অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন রফিক মিরসরাই, সীতাকুÐে যেসব অপারেশন বিশেষ করে ব্রিজ অপারেশন করেন, প্রত্যেকটা অপারেশনে ছাবের আহমদ আসগরী গাড়ি নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। এসব অপারেশনে এম.এ হান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুন, মোশাররফ হোসেন, মির্জা মনসুরও অংশগ্রহণ করেন।
নিউক্লিয়াসের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ গঠিত হলে এমএ মান্নান, এস, এম, ইউসুফ এবং ছাবের আহমদ আসগরী বিএলএফ সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিংয়ে পাঠানো এবং ইন্ডাকশনের কাজে নিয়োজিত থাকেন। তাঁর গাড়িটি এ সময় খুব কাজ দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে যখন সবাই দেশের ভিতরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত হয়, তখন ছাবের আহমদ আসগরী সীতাকুÐ, মিরসরাই ও স›দ্বীপের জোনাল কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে মিরসরাই আসেন।মাতবরহাটে তাঁর হেডকোয়ার্টার ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি সীতাকুÐে অবস্থান করেন। ১৭ ডিসেম্বর ভোরে সীতাকুÐের বিএলএফ ডেপুটি কমান্ডার মো. গোফরানুল হককে সঙ্গে গিয়ে ভাঙ্গা সড়ক ও সেতুগুলো অতিক্রম করে সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম সাকিট হাউসে এসে পৌঁছান। ১৭ তারিখ সকালে পাক বাহিনী চট্টগ্রামে আত্মসমর্পণ করে। সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে তখন বিজয় উৎসব শুরু হয়েছে। সেখানে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ছাবের আহমদ আসগরীসহ ডা. গোফরানুল হক বিজয় উৎসবে সামিল হন।
তখন স্টেশন রোডস্থ মিসকা হোটেল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনমেলা। ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ হতে ২৩ তারিখ পর্যন্ত যুদ্ধ পরবর্র্তী বাংলাদেশের অভিযাত্রা ও চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা ধরনের নাটকীয়তা ও ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়। ছাবের আহমদ আসগরী সেই ক্রান্তি লগ্নে সাহসিকতার সাথে তাঁর কিছু বিশ্বস্ত সহকর্মী যথাক্রমে জ্যেষ্ঠ নেতা আবুল কালাম আজাদ, মোখতার আহমদ, আবু ছালেহ এবং চট্টগ্রাম শহরের মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন, ডা. মাহফুজুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ সালাউদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার ইরফানুল হক ও গোফরানুল হককে নিয়ে কয়েকটি বৈঠক করেন এবং এই প্রচেষ্টার সাথে পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ও লোকমান গণি চৌধুরী যুক্ত হন। তৎকালীন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী নেতা এমএ হান্নান ও প্রফেসর নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছাবের আহমদ আসগরীর উদ্যোগ সকল করার জন্য যথাসাধ্য সমর্থন ও সাহায্য প্রদান করেন। কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর অভ‚তপূর্ব বলিষ্ঠ ভ‚মিকার কারণে চট্টগ্রামের তথা বাংলাদেশের রাজনীতির একটি ক্রান্তিকাল বিপর্যয়ের কিনারা হতে ফিরে আসে।
ছাবের আহমদ আসগরী দীর্ঘদিন থেকে গুরুতর রোগে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী আছেন। তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। পরপাড়ের ডাকের অপেক্ষায় দিন গুণছেন। বিরাট জীবনের সবকিছু এখন আর তাঁর মনে নেই। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে কথায় কথায় তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাসকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ৯ মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে পারে না। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ৯ মাস সশস্ত্র পর্যায়। ২৬ মার্চ আগ্রাসন দিবস। সশস্ত্র যুদ্ধের সময় আমি একটা পার্ট ছিলাম। আমরা তো সরে গেলাম। যারা নির্যাতিত হয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাদের অবদান অনেক বেশি। তারা না হলে আশ্রয় পেতাম না, খবরাখবর পেতাম না।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক