জোনাকী দত্ত
শিক্ষা হলো একটি জাতির মেরুদন্ড, আর শিক্ষক হলেন কান্ডারি। সমাজ তথা দেশের জন্য একজন শিক্ষকের অবদান অপরিসীম। তিনি অজ্ঞতা দূর করে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। তাই শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে।
আমার স্কুল এবং কলেজ জীবনের শিক্ষকদের আমি শ্রদ্ধা জানাই, যাঁরা আমাকে শিক্ষার আলো দিয়েছেন। সেই ছোট বেলা থেকেই আমি যতজন শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্য লাভ করেছি তাঁদের স্মৃতি যতটুকু মনে আছে আমি লেখার চেষ্টা করেছি। হয়তো বা সবার নাম আমার মনে নেই।
যখন খুব ছোট ছিলাম তখন দেখেছি আমার জেঠিমার কাছে অনেক বাচ্চা পড়তে আসতো। আমিও স্লেট, পেনসিল নিয়ে বসে যেতাম। বাল্যশিক্ষা, বর্ণপরিচয়, লিখতে পারা উনার কাছে শিখেছি। জেঠিমার কাছে বাল্যশিক্ষার একটা পড়া এখনো মনে পড়লে হাসি পায়। উনি যখন বাল্যশিক্ষা পড়াতেন আমরা সবাই তোতাপাখির মতো সুরে সুরে বলতাম। একটা নীতিবাক্য আছে ‘বিশৃঙ্খল ভাব ভালো নয়’। সেটাকে না বোঝে আমি বলতাম ‘বিশালের বাপ ভালো নয়’। কারণ তখন আমাদের পাড়ায় বিশালের বাপের একটা মুদি দোকান ছিল যেখানে বড়দের কাছে শুনেছি উনি জিনিস দেয়ার সময় ওজনে কমিয়ে দেয়। সেই ধারণা থেকে আমার বাক্যটি পড়ার সময় মনে হতো বইয়েও লেখা আছে বিশালের বাপ ভালো না। আমার মা-ও আমাকে পড়াতেন। মাকে দেখেই আমার গীতা শিক্ষা ও গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। আমার ছোট বেলায় বাবা মারা যায়। দাদার হাত ধরে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দাদার কাছে পড়তাম।
এছাড়া আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা এখনো এক আধটু মনে আছে। আমাদের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম একটু বয়স্ক ছিলেন। ছোট ছোট চোখ, মুখে একটু সাদা দাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি পরা সেই প্রধান শিক্ষকের চেহারা এখনো মনে আছে। অনেকে উনাকে বুড়া স্যার বলেও ডাকতো। গীতা দিদি আর স্বপ্না দিদি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একবার স্বপ্না দিদির প্রশ্নের উত্তর দিতে পারায় তিনি আমাকে সাবাস বলেছিলেন। গীতা দিদি সবসময় আমার লেখা পড়ার খবর নিতেন। গোলনাহার আপা আমি যখন স্কিপিং এ তৃতীয় হলাম পাশে দাঁড়িয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিয়েছিলেন। টিভিতে তখন একটা নাচের অনুষ্ঠান দেখাতো, সম্ভবত লায়লা হাসানের। টিভিতে দেখে আমি ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ নাচটা শিখে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে করেছিলাম। তাছাড়া ফেরদৌসী রহমানের গানের অনুষ্ঠান দেখে তখন অনেক গান শিখেছি। সেলিনা আপা, কামাল স্যার, ইসমাইল স্যার সবাই খুব আন্তরিক ভাবে পড়াতেন। আকরাম স্যার একবার সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতর জন্য আমাদের কিছু উপদেশমূলক লেখা বাংলা ও ইংরেজিতে এক পৃষ্ঠায় একটা করে লিখতে দিয়েছিলেন। ওখানের একটি লেখা আমি এখনো স্মরণ করি এবং আমার শিক্ষার্থীদের বলি ‘যে অন্যকে ফাঁকি দেয়, সে নিজেকেই ফাঁকি দেয়।’ তখন আমার প্রাইমারি স্কুলের শেষের দিকে যখন কাজল স্যার নতুন এসেছিলেন।
একদিন ক্লাসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কে কি হতে চাও। সবাই সবারটা বলেছে। কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা ব্যাংকার। আমি বলেছিলাম শিক্ষক হতে চাই। আরো কয়েকজন শিক্ষক হওয়ার কথা বলেছিল। প্রবাল স্যার ‘কোন এক মাকে’ কবিতাটি আমাকে সুন্দর করে অভিনয়ের মাধ্যমে শিখিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্কুলের সাথে আমাদের স্কুলের একটা প্রতিযোগিতায় আমি আবৃত্তি করি। ঘরে আমার দাদাও বারবার মুখস্থ করিয়ে দেখিয়ে দিলো কিভাবে করতে হবে। আমি প্রথম হয়ে একটি বই উপহার পেয়েছিলাম। আমিন স্যার একটু কড়া আবার পড়া পারলে খুব স্নেহ করতেন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় জানলাম আমিন স্যার পঞ্চম শ্রেণিতে গণিত পড়ায়। আর উনি বেশিরভাগ অঙ্ক ক্লাসে যে ফার্স্ট হতো তাকে বø্যাকবোর্ডে করতে দিতো। মাঝে মাঝে আমরা উঁকি দিয়ে দেখতাম। উনার হাতে একটা বেত থাকতো। সেটা দেখার পর আমি ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পঞ্চম শ্রেণিতে যেন প্রথম না হই। কিন্তু বরাবরের মতো হয়ে গেলাম। আর স্যারদের পড়া বুঝে উনাদের ঠিক মতো দিতে পারলে স্যাররা যে কতোটা খুশি হতেন তা বলে বোঝানো যাবে না। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য উনি আমাদের কোচিং করাতেন। আমরা সকালে স্কুলে এসে যেতাম। স্যার এসে আমাদের মাঠে খেলতে দেখলে একটা বেত নিয়ে তাড়া করতেন ক্লাসে যাওয়ার জন্য। মাঠে একটা বড় জাম গাছ ছিল। জাম কুড়িয়ে সবাই মজা করে খেতাম। এরপর মাঝে মাঝে উনার পড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য উনাকে কখনো গান গেয়ে বা আমরা কয়েকজন মিলে “কুপোকাত” গল্পটি অভিনয় করে দেখাতাম। উনি খুশি হতেন। আমিন স্যার আমাদের যেমন শাসন করতেন তেমনি স্নেহও করতেন। আসলে আমি প্রাইমারিতে অনেক ভালো শিক্ষককে পেয়েছি কারণ তখন একজন বিদায় নিয়ে অন্যজন বদলি হয়ে এসেছিলেন। আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের আমি শ্রদ্ধা জানাই যাঁরা আমাকে উপরের শ্রেণিতে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন আন্তরিকতার সাথে, স্নেহ ও শাসন দিয়ে। এরপর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রধান শিক্ষক গুরুগম্ভীর মানিক স্যার একজন অমায়িক মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের মাঝে মাঝে ক্লাস নিতেন। উনার শাসন ও স্নেহে আমরা পাঁচটি বছর হালিশহর মুন্সীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অতিবাহিত করেছি। এই স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শাখায় আমাদের দশ বছরের অনেক সুন্দর স্মৃতি রয়েছে। সহকারী প্রধান শিক্ষক মৃণাল স্যার আমাদের গণিত আর বিজ্ঞান পড়াতেন। উনার পড়ার কৌশল এতোই নিখুঁত ছিল যে আমাদের কারো কারো ক্লাসেই পড়া মুখস্থ হয়ে যেত। তিনি প্রায় সময় জ্যামিতি বোঝানোর সময় বলতেন, মনোযোগ দিলে তোমাদের এখানেই শেখা হয়ে যাবে। বাসায় গিয়ে একটু চোখ বুলিয়ে নিলে হবে। হক স্যার ইংরেজি পড়াতেন। উনাকে ভীষণ ভয় পেতাম। কারণ উনি পড়া লেখান কম, বেশিরভাগ মুখস্থ ধরেন যা আমরা অনেকে শিখলেও বলতে পারতাম না। উনি প্যারাগ্রাফ মুখস্থ ধরার সময় যে যেভাবে দাঁড়িয়ে বলতো তাদের এক একজনকে এক একরকম কথা বলত। কাউকে বলত তুই ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে বলছিস কেন, আবার কাউকে বলতো রেলগাড়ির মতো দ্রæতগতিতে বলছিস কেন, প্রতি লাইনে এ্যাঁ এ্যাঁ করছিস কেন ইত্যাদি। ছেলেদের ফুলহাতা শার্ট ভাঁজ করে পড়তে দেখলে ভীষণ রেগে যেতেন আর সাথে সাথেই তা ফুল করে পড়তে বলতেন।
তিনি বলতেন যে ভাঁজ করে যদি পরিস তাহলে ফুলহাতা শার্ট পরার দরকার কি, হাফ শার্ট পরলে তো হয়। আমাদের গণিত আর বিজ্ঞানের আর এক স্যার ফণিভূষণ বড়–য়া। তিনি খুব হাসিখুশি ছিলেন। পড়ানোর সময় যেমন ভালো বোঝাতেন তেমনি কড়াও ছিলেন। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমাদের স্কুলে আলাদাভাবে কোচিং পড়াতেন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা। ফণিস্যারের বায়োলজির প্র্যাকটিকেল ক্লাস খুব ভালো লাগতো। আমাদের রেখা ম্যাডাম গণিত আর বিজ্ঞান পড়াতেন। তিনি চমৎকারভাবে পড়া বুঝাতেন। তিনি আবার আমাদের গানের শিক্ষকও ছিলেন। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, অ্যাসেম্বলিতে গান করার পাশাপাশি বিকেলে শিক্ষার্থীদের গান শেখাতেন। ফিরোজ স্যারকে বেশিদিন পাইনি। শান্ত স্বভাবের ছিলেন তিনি। তিনি একবার আমার জন্য রেখা ম্যাডামকে বলেছিলেন আমাকে যেন গান শেখায়। আমিও দুই তিন দিন গিয়েছিলাম গান শিখতে। কিন্তু আর শেখা হয়নি। আমার দাদার ধারণা যেহেতু আমি ক্লাসে ফার্স্ট হতাম তাই লেখাপড়া ছাড়া অন্য কিছুতে মন দিলে আমার ক্ষতি হবে। মেধা তালিকায় থাকা অনেক কষ্টের হয়ে যাবে। এমনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম। একবার আমাদের বাংলার সুজন স্যার আমার ষষ্ঠ শ্রেণিতে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অভিনয় দেখে বলেছিলেন আমাকে টিভিতে সুযোগ করে দেবেন। কিন্তু তিনিও বেশিদিন ছিলেন না। আমাদের ইংরেজি শিক্ষিকা ফজিলাতুন্নেসা আপা হেসে হেসে মিষ্টি করে ইংরেজি পড়াতেন। আর বাংলা ব্যাকরণ শিক্ষক মমতাজ আপা একটু কড়া তবে আন্তরিকতার সাথে পড়াতেন। ইংরেজি ব্যাকরণ শিক্ষক মোক্তার স্যার পড়া না পারলে বেতের বাড়ি দিতেন। তবে ব্যাকরণ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। আমাদের হুজুর ইসলাম ধর্ম ও সমাজ পড়াতেন। উনি মজার মজার কথা বলতেন। বাবুল স্যার বাংলা ব্যাকরণ আর হিন্দু ধর্ম পড়াতেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আসলে আমার বাবা খুব ছোট বেলায় মারা যান। সেজন্য আমাকে সব শিক্ষক ভালোবাসতেন। আমার প্রতি একটা আলাদা মমতা ছিল। আমাদের শেষের দিকে পন্ডিত স্যার এসেছিলেন। উনি ধর্ম পড়াতেন। বেশ গুরুগম্ভীর, রাশভারী। তবে উনার মুখেও মাঝে মাঝে হাসি দেখা যেত। আমাদের সময়ে প্রত্যেক শিক্ষক এতোই আন্তরিকতার সাথে পড়াতেন যে আমাদের বেশিরভাগ পড়া ক্লাসে শেষ হয়ে যেত।
আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার ছোট বেলার বন্ধু এ্যাপোলো যে শিক্ষকের কাছে পড়ত তার নাম বাবুল বৈদ্য। উনি একদিন আমার সম্পর্কে ওর কাছে জেনে নিয়ে আমাকে একদিন দেখা করতে বললেন। আমরা একই পাড়ায় থাকি। আমি উনার সাথে দেখা করার পর জানলাম উনি আমার দাদার বন্ধুর বড় ভাই। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কারো কাছে পড়ি কিনা। আমি জানালাম, না। যে পড়াগুলো আমি পারিনা দাদা দেখিয়ে দেয়। আমার দাদাকে দেখা করতে বললেন। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার আগে আমি উনার কাছে পড়া শুরু করলাম। উনার পড়ানোর ধরনটা ছিল অন্যরকম। আমাদের সব পড়া বিভিন্ন গাইড থেকে সংগ্রহ করে নোট করে পড়াতেন এমনকি রচনাও। উনার থেকে শিখেছি যে একটা অধ্যায় ভালো ভাবে পড়লে ঐ অধ্যায় থেকে কমন প্রশ্ন না পড়লেও কীভাবে লিখতে হয়। আমাদের পড়া দেখে আমাদের আর এক স্কুলের বন্ধু ফেরদৌস আরা উনার কাছে পড়ত। সম্ভবত সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন উনি আমাকে প্রধান শিক্ষক দিয়ে একটা ট্রান্সলেশনের ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক ইংরেজি কি জিজ্ঞেস করলেন। আমি অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলাম ফার্স্ট টিচার। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলে আমি একই উত্তর দিলাম। তখন তিনি আমাকে হাত পাততে বললেন। তেঁতুল গাছের ডাল দিয়ে দুই হাতে দুইটা বাড়ি দিলেন। উফ্ কি যে ব্যথা পেয়েছিলাম। তবে এরপর আর কোনদিন উনার বেতের বাড়ি খেতে হয়নি। খুব ভয় পেতাম স্যারদের বেতের বাড়ি। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন উনি আমাকে দিনে দুইবার করে পড়াতেন।
আমি অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তিও পেয়েছিলাম। সেবছর আমাদের স্কুল থেকে আমি আর নার্গিস আমরা দুজন বৃত্তি পেয়েছিলাম। প্রতিবছর ক্লাসে আমি প্রথম আর নার্গিস দ্বিতীয় হতো। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল কিন্তু পড়ালেখায় ছিল তুমুল প্রতিযোগিতা। বাবুলদা এখনো দেখা হলে অন্যের সামনে আমার লেখা পড়ার এতো সুনাম করে যে আমার লজ্জা লাগে কারণ আমি ছোটবেলা থেকে যেভাবে পড়ে এসেছি জীবনে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। দশম শ্রেণিতে দাদার আর এক বন্ধুর ছোট ভাই তপনদার কাছে আমি আর এ্যাপোলো পড়তাম। আমাদের আর এক বন্ধু শিমুলও পড়ত, ও আবার অন্য স্কুলের ছিল। তপনদা ব্যাচ করে পড়াতেন। উনার কাছে এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছিলাম। উনিও খুব আন্তরিকতার সাথে যেকোন পড়া ভালো করে বুঝিয়ে দিতেন। এসএসসি পরীক্ষার সময় উনি বোর্ডের পরীক্ষার মতো আমাদের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। এমনকি আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান করে একটা করে কলম উপহার দিয়েছিলেন। কাকতালীয় ভাবে উনার পরীক্ষায় আমি ৮১৯.৫ নম্বর পেয়েছি আর ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত এস এস সি পরীক্ষায় ৮২০ নম্বর পাই। স্কুলের শিক্ষক এবং তপনদা আশা করেছিল আমি স্ট্যান্ড করব কিন্তু অল্প নাম্বারের জন্য তা আর হলো না। এরপর বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে বিশেষ অসুবিধার কারণে ভর্তি হলাম এইচএসসিতে মানবিকে সিটি কলেজে। ওখানে পেলাম শঙ্কর জলদাস স্যার, পার্থ সারথি স্যার, হাসান স্যার এবং আরো অনেকে ছিলেন এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না। অর্থনীতি পড়াতেন একটা ম্যাডাম আর ইউসুফ স্যার। ইউসুফ স্যারকে আবার চট্টগ্রাম কলেজেও পেয়েছিলাম এবং মাস্টার্স এ উনার কাছে ব্যাচে পড়তাম। যুক্তিবিদ্যার রীতা দত্ত দিদির পড়া এতো ভালো লাগতো পুরো ক্লাস চুপ হয়ে যেতো। এতো সুন্দর করে আন্তরিকতার সাথে উনি পড়া বুঝাতেন যে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। পরে দিদিমণিকে পেলাম আমার কর্মস্থল প্রবর্তক স্কুলে প্রভাতী শাখায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে। উনার সান্নিধ্যে আসতে পেরে আমি গর্বিত। এরপর পেলাম চট্টগ্রাম একাডেমিতে। উনার সহযোগিতা, আন্তরিকতা এবং আশীর্বাদ এখনো আমি পেয়ে যাচ্ছি। দিদিমণির বক্তব্য এতো ভালো লাগে সেই কলেজে পড়ার মতো মুগ্ধ হয়ে শুনি। তিনি চমৎকার গান করেন। উনার কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব ভালো লাগে। দিদিমণির সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স মাস্টার্স পড়ার সময় পেয়েছি দিলরুবা ম্যাডাম, বারী স্যার, মাঈনুদ্দিন স্যার, ইউসুফ স্যার, আহমেদ স্যার। অনার্সে ভর্তি হয়ে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমার শশুর কোন কোন বই কিনতে হবে তা জেনে কিনে দিয়েছিলেন এবং মাঝে মাঝে কোচিং ক্লাসে ও কলেজে আমাকে মোটরসাইকেলে করে দিয়ে আসতেন। তাছাড়া লেখা পড়ার খবরও নিতেন। আমার স্বামী পরীক্ষার সময় আমার পড়া মুখস্থ নিতেন যা আমার অনেক উপকারে এসেছে। বিয়ের পর লেখা পড়া চালিয়ে যেতে আমার জা’ এর অবদানও কম নয়। ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’। আসলে আমরা সবসময় কারো না কারো কাছে শিখছি। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত আমাদের শিক্ষার শেষ নেই। বিয়ের কয়েক মাস পর আমার মা মারা গেল।
আমাদের ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় আমার জন্য ভালো হলো কারণ পরীক্ষার আগে আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হলো। এরপর নানা সমস্যার মধ্যে আমি যখন পরীক্ষার ফলাফল জানতে গেলাম তখন মাঈনুদ্দিন স্যার আমাকে অভিনন্দন জানালেন কারণ সেই পরীক্ষায় আমরা পাঁচজন প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলাম। অনার্সে সেলিম স্যারের কাছে ব্যাচে পড়েছি আর মাস্টার্সে ইউসুফ স্যারের কাছে। উনারা খুব ভালো পড়াতেন। আমার জীবনে আমি যতজন শিক্ষক পেয়েছি সবাইকে আন্তরিক ভাবে আমি প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই। আমার স্কুল ও কলেজ জীবনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আমার স্কুল জীবন যে স্কুলে দশ বছর ধরে কাটানো সময় আমার চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার শিক্ষকদের সম্পর্কে কিছুটা স্মৃতিচারণ করে তাঁদের স্মরণ করলাম। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আসলে আমাদের সময়ে শিক্ষকদের শাসন, স্নেহ, পাঠদান এতোই আন্তরিক ছিল যে চিরকাল তাঁরা শিক্ষার্থীদের মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সকল শিক্ষকদের প্রতি আমি আবারও বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক