শোকে-ক্ষোভে শহীদ সাইফুল ইসলাম আলিফকে চিরবিদায়

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে শোকে-ক্ষোভে চিরবিদায় জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের চার দফায় জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে। গতকাল বুধবার নগরের কোর্ট বিল্ডিং ও জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদ মাঠে দুই দফায় শহীদ আলিফের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়নের ফারেঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে দুই দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার তিন দফা জানাজাতেই ছিল জনস্রোত। মঙ্গলবার সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন সাইফুল ইসলাম আলিফ। তিনি সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) ছিলেন।
হামলায় নিহত সাইফুল ইসলামের প্রথম জানাজা হয় চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে। গতকাল সকালে শেষবারের মতো নিজের কর্মস্থলে আনা হয় তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে। তবে নিথর আর কফিনবন্দি হয়ে। এতে সিক্ত হলেন সহকর্মীদের অশ্রæ আর ভালোবাসায়। এসময় তার হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান সহকর্মীরা। সেখানে আইনজীবী, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। নামাজে জানাজার আগে আইনজীবী নেতারা বক্তব্য দিয়ে সাইফুল হত্যাকান্ডে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। নামাজ শেষে উপস্থিত আইনজীবীরা অবিলম্বে আলিফের খুনিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ফাঁসির দাবি জানান। এছাড়া ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবি তোলেন তারা। কেউ কেউ এ সময় সহকর্মী আলিফের স্মৃতিচারণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এসময় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আপনারা জানেন আমাদের প্রিয় ভাই আলিফ গতকাল (মঙ্গলবার) ইসকন সন্ত্রাসীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছে। তাই আইনজীবী সমিতির পক্ষ হতে আজকে কর্মবিরতি পালন করা হচ্ছে। জানাজা শেষে আমরা আজকে বারে বসব। এরপর আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবো।’
তিনি বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণে আসামির প্রিজন ভ্যান ঘেরাও করে রেখে গতকাল আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। এটিও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ড বলে আমরা মনে করি। এই হত্যার বিচারের দাবিতে আইনজীবী সমিতি জিরো টলারেন্স নীতিতে অবস্থান নেবে।’
আসামিদের পক্ষে আইনজীবীরা লড়বেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসামিদের পক্ষে আইনজীবী লড়লে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাব আমাদের ভ‚মিকা কী হবে।’
নিহত সাইফুলের বোন বলেন, ‘সে আইনজীবীদের মধ্যে এতো ভালো ছিল যে তার মতো আইনজীবী নেই। সে সবার ভালো চেয়েছে। অনেকের কাছে টাকাও নেয়নি।’
এরপর আদালত চত্বর থেকে দ্বিতীয় জানাজার জন্য মরদেহ নেওয়া হয় জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে। সেখানে জানাজায় অংশ নিতে সকাল থেকেই লোকজন এসে জড়ো হতে থাকেন। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকেও জানাজায় অংশ নিতে লোক এসে উপস্থিত হয়েছেন। সকাল ১১টার দিকে জমিয়তুল ফালাহ মাঠে জনস্রোত তৈরি হয়। জানাজা শেষে মুসল্লিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি জমিয়াতুল ফালাহ থেকে শুরু হয়ে নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
জানাজায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, নগর বিএনপির আহব্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, নগর জামায়াতের আমীর শাহজাহান চৌধুরীসহ আরও অনেক রাজনীতিবিদ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ঢাকা থেকে এসে জানাজায় যোগ দেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহব্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
জানাজায় অংশ নিয়ে ভূমি ও বেসামরিক বিমান উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ জানান, ‘দেশে চক্রান্ত চলছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করার সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা হবে।’
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, ‘ভারতে বসে ষড়যন্ত্র করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনা ও তার দোসররা।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহব্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের হিন্দু ভাই, এমন হয়নি যে তার মন্দির ভাঙা হয়েছে, সম্পদ দখল হয়েছে। আমাদের দাড়ি-টুপিওয়ালা ভাইরাই তাদের মন্দির পাহারা দিয়েছে। আমরা দেখেছি যে ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। ভারতে বসে উনি দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার পাঁয়তারা করছেন।’
সমন্বয়করা আইনজীবী আলিফের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দিয়েছেন।
এ সময় শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘কোনো বক্তব্য নাই আর। শুধু প্রশাসনের ভাইদেরকে বলতে চাই, গত ১৫ দিন ধরেই আমি বলে আসতেছিলাম; এই চিন্ময় দাস উস্কানিমূলক সমাবেশ প্রেস ক্লাবের সামনে করেছে, চেরাগির পাহাড়ে করেছে, লালদীঘির ময়দানে করেছে। আমি বলেছি এরা বেড়ে যাচ্ছে। তাদের আর কোনো কর্মসূচি করতে দিবেন না। কিন্তু কেউ আমার কথার পাত্তা দেননি।’
পরে এই হত্যাকান্ডে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত ও শাস্তির দাবিতে নগরীর টাইগার পাস মোড়ে সমাবেশ করে ছাত্র-জনতা।

নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত :
পূর্বদেশ এর লোহাগাড়া প্রতিনিধি জানান, লোহাগাড়ায় দুই দফা জানাজা শেষে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আইনজীবী সাইফুুল ইসলাম আলিফ। গতকাল বুধবার দুপুর আড়াইটায় উপজেলার সদর ইউনিয়নের কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম স্টেডিয়ামে প্রথম ও আছরের নামাজের পর চুনতি ইউনিয়নের ফারাঙ্গা লতাপীর মাজার সংলগ্ন মসজিদ মাঠে দ্বিতীয় দফা নামাজে জানাজা শেষে তাকে সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। গ্রামের বাড়িতে আইনজীবী আলিফের জানাজায় দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ শরিক হতে আসেন।
লোহাগাড়ায় দ্বিতীয় দফা জানাজার পূর্বে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাওলানা বদরুল হক, লোহাগাড়া উপজেলা বিএনপির আহব্বায়ক নাজমুল মোস্তফা আমিন, লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইনামুল হাছান, বান্দরবান জেলা জামায়াতের আমীর এস এম আবদুস ছালাম আজাদ, এডভোকেট ফরিদ উদ্দিন, কাজী নাছির উদ্দিন, মোহাদ্দেছ শাহ আলম ও এডভোকেট আলিফের পিতা জামাল উদ্দিনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এসময় বক্তারা এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করে দ্রুতসময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
দাফনের পরে কবর জেয়ারত করেন চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর শাহজাহান চৌধুরী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, অন্যতম সমন্বয় সারজিস আলম, চট্টগ্রামের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি প্রমুখ। পরে তারা এডভোকেট আলিফের পিতার সাথে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
এসময় সারজিস আলম বলেন, ‘শান্তি, সম্প্রীতি এবং অগ্রগতি রক্ষায় যে যাত্রা অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করেছে, তাকে বানচাল করার জন্য একটি অপশক্তি জেগে উঠেছে। তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। কোনো উগ্রবাদের স্থান বাংলাদেশে হবে না। এই পর্যন্ত যতগুলো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটি ঘটনার বিচার হবে। যদি সাধারণ আইনে না হয়, তাহলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অপকর্মকারীদের বিচার করা হবে। সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে যে শঙ্কা ও ভীতি রয়েছে, সেটি দূর করতে চাই। উগ্রবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রুখে দাঁড়াতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহব্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে ইসকনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা ভুলে যাই নাই আওয়ামী লীগের সহায়তায় এই ইসকন কিভাবে গত ১৬ বছর পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠে আজকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে স্বৈরাচারের সঙ্গী হয়ে ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই ভারতের বুবু, ভারতের হাসিনা এই বাংলাদেশে তোমার আর ঠাঁই হবে না। ভারতে বসে যতই ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করা হয় আমরা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ সেই ষড়যন্ত্র রুখে দিবো।’