নিজস্ব প্রতিবেদক
ভূখন্ড দখল কিংবা চেতনায় আধিপত্য বিস্তারে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লাহ্র পলাশী থেকে শুরু করে বৃটিশবিরোধী ও মাতৃভাষা আন্দোলন হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে জাতীয় জীবনে শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া অজস্র নিপীড়ন ও বঞ্চনা অসীম সাহস আর আত্মত্যাগের অমিত শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করেছে বাঙালি জাতি। অধিকার আদায়ে বাঙালির লড়াকু ভূমিকাই গোটা জাতির পরিচয়ের আগে ‘বীর’ উপাধিটি যুক্ত করে দিয়েছে। ‘বীর বাঙালি’ পরিচয়েই রচিত হয়েছে বাঙালির বীরত্বের ইতিহাস। আবার বাঙালির উর্বর ইতিহাসের বাঁক বদলের কয়েকটি পৃষ্ঠা জুড়ে যে ‘কালো অধ্যায়’ রচিত হয়েছে, তার কারিগরও ছিলেন কতিপয় বাঙালি। জাতির ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা মীরজাফর থেকে মেজর ডালিমের মত কাপুরুষ এবং বেঈমানেরও সাক্ষাত মিলে দুঃখীনি বাংলার সবুজ জমিনে।
বিশ্ব পরিমন্ডলে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য বুকের তাজা রক্ত দেয়ার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যেমন একমাত্র বাঙালি জাতিরই রয়েছে, তেমনি ঘৃণ্যতম বেঈমানির ইতিহাসও পৃথিবীতে বিরল। একটি জাতির স্বাধীনতার স্থপতি কিংবা জাতির জনককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মতই হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করতে ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারির মত জঘন্য কলঙ্কময় ঘটনাও আর কোনও জাতি ঘটিয়েছে বা ঘটাতে পেরেছে বলে তথ্য মেলে না।
ঊনিশ শ’ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকা ঘেঁটে জানা যায়, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যকারীদের বাঁচানোর জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন স্ব-ঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ (যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন) ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর রয়েছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন।
অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
এরপর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হস আরেক সামরিক শাসক মেজর জিয়া। তিনি ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় জারি করা সব অধ্যাদেশ ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেন।