রতন কুমার তুরী
এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে লাল দীঘির পাড়ে আব্দুল জব্বারের বলীখেলা হয়ে আসছে। এটি এখন চট্টগ্রামের মানুষের শত বছরের ঐতিহ্য। ইতিহাস বলে, ১১৫ বছর আগে চট্টগ্রাম শহরের বদর পাতির ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এ অঞ্চলের যুবকদের শারীরিকভাবে প্রস্তুত করতে ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আয়োজন করেন কুস্তির, যা বলী খেলা নামে পরিচিত। একসময় এখানে শুধু বলীখেলা হতো চট্টগ্রাম শহরের মানুষ গোল করে বলী খেলা দেখতো। তারপর আস্তে আস্তে মানুষের সমসগম বাড়তে থাকে এবং মানুষের জন্য শরবতের দোকান সামান্য খাবারের দোকান বসতে থাকে। তখনকার দোকানগুলো ছিলো টং দোকানের মতো শুধু চট্টগ্রাম শহরের মানুষ ভিত্তিক। কালক্রমে লালদীঘি এলাকায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার মানুষেরা দল বেঁধে বলীখেলা দেখতে আসতে থাকে এবং বলীখেলায় জনসমাগম বাড়তে থাকে এতে মানুষ উক্ত এলাকায় নানা ধরনে জিনিষপত্র বিক্রি করে তাদের আয় রোগজার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জব্বারের বলীখেলা সচরাচর বাংলা নতুন বছরের মাঝামাঝিতে শুরু হলেও এক সময় মোলার আয়োজন চলতো তারও আগে থেকে। এমেলা একসময় দীর্ঘ একমাস ধরে লালদীঘির মাঠে চলতো সেসময় অবশ্য চট্টগ্রাম শহরে মানুষজন কম ছিলো। যানজট ছিলােনা। কালক্রমে এ বলীখেলার সুনাম বাংলাদেশের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দেশে আনাচে কানাচে থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের বিভিন্ন জিনিষপত্র বিক্রি করতে এমেলাতে চলে আসতে থাকে ফলে এমেলায় বেচাবিক্রি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে হস্ত শিল্প জাতীয় জিনিষপত্র, ফুলের ঝাড়ু, বিভিন্ন পদের মিস্টান্ন, আচার, ছোট ছেলে মেয়েদের খেলনাসহ আরো অসংখ্য জিনিষপত্র ওঠে জব্বারের বলী খেলা। এসব জিনিষপত্র সহজে সচরাচর চট্টগ্রামের বিপণী বিতান সমূহে পাওয়া যায়না ফলে চট্টগ্রামসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলার মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে এ মেলার জন্য। মুলতঃ জব্বারের বলী খেলার সাথে সাথে লালদীঘি এলাকার এমেলারও ঐতিহ্যের ইতিহাসও শতবছরের ফলে মেলায় ওঠা জিনিপত্র কেনার জন্য মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে।
বর্তমানে লালদীঘি এলাকার যানযট এড়াতে জব্বারের বলীখেলার মেলার মেয়াদ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এ সময় সপ্তাহ কিংবা দশদিন ধরে চলা জব্বারের বলীখেলার মেলা বর্তমানে তিনদিনে সমাপ্ত করার প্রশাসনিক নির্দেশ রয়েছে যা চট্টগ্রামের মানুষের জন্য খুবই দুঃখজনক।
চট্টগ্রামের মানুষ জব্বারের বলীখেলার পাশাপাশি লালদীঘি জুড়ে এ মেলাকে বেশ ভালোবাসে তাই তারা সারাদিন না পারলেও একেবারে ভোরের দিকে নারী, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ বনিতা ছুটে যেতো লালদিঘির পাড় এলাকায় মেলা প্রাঙ্গনে। সবাই ঘুরেঘুরে বিভিন্ন কিছু কিনে বাসায় ফিরতো। অনেকে আবার দূরদূরান্ত থেকে এসে দোকান নিয়ে বসতো। এখনও সে নিয়ম অব্যাহত আছে। হঠাৎ মেলার সময়সীমা কমে যাওয়ায় এসমস্ত খুচরা ব্যবসায়ীরা খুববেশি বেকায়দায় পারেছে। এ বছর জব্বারের বলী খেলায় চট্টগ্রামের প্রশাসন রাস্তাজুড়ে দোকান বসা বন্ধ করে দেয়ায় দূরদূরান্ত থেকে ব্যবসা করতে আসা ব্যবসায়ীরা বেশ লোকশান গুণতে হচ্ছে। এ কারণে জব্বারের বলীখেলা দেখতে আসা মানুষজনও মেলা থেকে টুকিটাকি জনিষপত্র কিনতে সমস্যায় পরতো হচ্ছে। এ বিষয়টি চট্টগ্রামের প্রশাসন আগে থেকে বলা উচিত ছিলো।
আমাদের শত বছরের ঐতিহ্য জব্বারের বলীখেলার যাতে সামন্যতম ব্যাঘাত না ঘটে সে বিষয়ে আয়োজকদের নজর রাখা উচিত। মুলত জব্বারের বলীখেলার মুল আকর্ষণ বলীখেলা হলেও মেলা দেখতেও অসংখ্য মানুষের সমাগম ঘটে। ফলে মেলাটি কীভাবে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায় এ বিষয় টিও চট্টগ্রামের প্রশাসনের মাথায় রাখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে মেলার মাঝপথে জব্বারের বলীখেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে চট্টগ্রাম ছাড়াও অন্যান্য জায়গার বলীরাও উপস্থিত থাকে এবং রাউন্ডের পর রাউন্ড বলী খেলা চলতে থাকে। অপেক্ষাকৃত দক্ষ এবং পরিচিত বলীরা এ খেলায় অংশ গ্রহণ করে তাদের বিজয়ের মালা ছিনিয়ে নেয়। এ বছর ১১৬ তম বলীর আসর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো লালদীঘির ময়দানে। অসখংখ্য বলীপ্রমি মানুষ উপস্থিত ছিলো খেলায়। সবাই তাদের নিজনিজ বলীদের নামে জয়োধ্বনি দিচ্ছিলো। সবাইকে হারিয়ে কুমিল্লার বাঘা শরীফ বলী এবার চ্যাম্পিয়নের মালা পরিধান করলো। গত বছরও এ বলী জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়নের বিজয়মালা ছিনিয়ে নিয়েছিলো। আগামি বছর আরো বিখ্যাত বলীরা খেলায় অংশ গ্রহণ করবে বলে সবাই প্রত্যাশা করছে।
এদিকে প্রশাসন আন্দরকিল্লা থেকে লালদীঘি পাড় পর্যন্ত সড়কে মেলার কোনো দোকান বসতে না দিলেও মুল জায়গায় দোকানগুলো এখনও রয়েছে। সড়কেও কিছুকিছু ভাসমান দোকান দৃশ্যমান হচ্ছে। আশা করছি আগামি বছর প্রশাসন জব্বারের বলীখেলার পাশাপাশি উক্ত এলাকায় মেলাটি কীভাবে সুসম্পন্ন করা যায় তা আগেভাগেই পরিকল্পনা করে রাখবেন। আমরা চাই আমাদের শতবছরের ঐতিহ্য জব্বারের বলীখেলায় সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটুক।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক