অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব
শুধু তেল, মরিচ পানি দিয়ে তরকারি আগুনে সিদ্ধ করলে রান্না হয় না। রান্নার মতো রান্না হতে হলে একটি প্রক্রিয়া লাগে। তেমনি শিক্ষা দান করলে হয় না। সেই শিক্ষা দানেরও একটি প্রক্রিয়া থাকে। সেই প্রক্রিয়া আবার শুধু জানলে হয় না। তা প্রয়োগে দক্ষ হতে হয়, প্রাজ্ঞও হতে হয়। কেননা সেই শিক্ষা একটি মানসিক দক্ষতা, যা একজন থেকে অন্য জনের কাছে স্থানান্তর করা যায়, সংরক্ষণ করাও যায়। যা অন্যের কাছে স্থানান্তর করতে হয় তা যদি মানসিক বিষয় হয় তা হলে তো সেখানে আবার শুধুই প্রক্রিয়া থাকলে হয় না। প্রক্রিয়ার সাথে অন্য একটি বিশেষত্ব থাকতে হয়। সেটা হলো শৈল্পিকসত্ত¡া। যেখানে ব্যক্তি বিশেষের নিজস্বতা থাকে। সেই নিজস্বতার কারণে এক শিক্ষক অপর শিক্ষক থেকে ভিন্ন হয়ে যায়। যেমন গায়ক বা কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে কন্ঠের উপস্থাপনা শৈলীর নিজস্বতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। কারো কন্ঠের গানটি শুনতে আগ্রহ জাগে, কারোটা শোনার ভয়ে পালিয়ে বেড়াই। এই যা। তেমনি শিক্ষাদান করলে হয় না, তার পরিবেশনাকেও গুরুত্ব দিতে হয়। যেটা রপ্ত করতে অভিজ্ঞতার যেমন প্রয়োজন হয় তেমনি নিজস্বতায় প্রকাশ করতে তাড়নাও থাকতে হয়,আবার সময়োপযোগীও হতে হয়। যেমন আগে ভারত- কাশ্মিরের যুদ্ধের খবর কয়েক সপ্তাহ পর পত্রিকার মাধ্যমে পেতাম, পরে বেতারের মাধ্যমে। এর পরে দূরদর্শনের মাধ্যমে চলমান দৃশ্যসহ দেখতে পাওয়া শুরু হলো। সাম্প্রতিক কালে স্যাটেলাইট কৃত্রিম উপগ্রহ ও ড্রোনের মাধ্যমে সরাসরি প্রতিনিয়ত দেখার সুযোগ থাকছে, যেখানে ফটোগ্রাফারের, উপস্থাপকের, শিল্পনির্দেশকের স্ক্রিপ্ট রাইটারদের স্ব স্ব শৈল্পিক গুনের প্রকাশ ঘটে। তাই দর্শক-শ্রোতাদের তাতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। অনুরূপ মনোযোগ বাড়াতে ও শিক্ষার বিষয়ের আগ্রহ বাড়াতে পরিবেশনার দিকটা যেমন দেখতে হয় তেমনি কিভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় শিখতে হয় তাও তাঁকে রপ্ত করাতে হয়, শেখাতে হয়। যখন সে শিখতে শেখা হবে ও জানবে তখন তার জ্ঞান স্পৃহা বেড়ে যাবে। শিখতে শেখা হলো অসীম জ্ঞানের মহাসড়কে এগিয়ে চলার প্রাথমিক প্রস্তুতি। শিখন শেখানোতে জ্ঞান আহরণের পদ্ধতি জানা যায়, তা নিজের কাজে লাগানোতে আত্মস্থ করে। তখন শিষ্য যতই ছুটতে থাকে সেই মহাসড়কের পথে ততই তার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়, এগিয়ে যাবার, জ্ঞানের প্রান্ত সীমায় পৌঁছার। এই যে জ্ঞানের রাজ্যে, শিখার বিষয়ে বিরামহীন হয়ে চলায় তার চিন্তাপ্রবাহও উৎকর্ষ হয়। নিজে তখন বদলাতে থাকে। অন্যদিকে তার পরিবেশও বদলাতে ভূমিকা রাখে। আবার এক সময় তাঁর মধ্যেও জ্ঞানসাগরে অবদান রাখার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠতে পারে। অবিরাম চলতে পারার সক্ষমতা অর্জন করতে পারায় তখন এক সময় জ্ঞানের ¯্রষ্টা হয়ে উঠতে পারে শিষ্য। এখানে শিষ্য শিখতে শেখানোর ফলে সফল হয়ে উঠে, গুরু তখন আর নিষ্ফলা মাঠের কৃষক থাকেন না। প্রকৃত শিক্ষক শিষ্যের এই জ্ঞান ¯্রষ্টার রূপের মধ্যে নিজের আসল সার্থকতা খোঁজে পান, সেই শিষ্যের মাঝে নিজের জ্ঞানচিন্তার অস্তিত্বের প্রবাহের মাঝে নিজের সার্থকতা দেখেন। তাই একজন শিক্ষক শিক্ষাদানে তথা দক্ষতা স্থানান্তরে শৈল্পিক প্রক্রিয়ায় থাকার আকাক্সক্ষা রাখেন। কিন্তু সবার প্রত্যাশিতমানে সেই শৈল্পিকসত্ত¡া নিয়ে থাকা সম্ভব হয় না।
শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার সাথে শৈল্পিক হয়ে উঠতে পারলে তিনি শিক্ষার্থীপ্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেন, আর শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময়ে সেই প্রিয় শিক্ষককে আরও মর্যাদাময় করার জন্য তাদের জীবনের ‘গুরু’ হিসাবে সেই শিক্ষককে মেনে নেয়। গুরু দাক্ষিণ্য হিসাবে তাদের সেই প্রিয় শিক্ষককে নানাভাবে সম্মান জানায়ে থাকে। তবে যে শিরোনাম দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করে ছিলাম ‘শেখানো, না শিখতে শেখানো গুরুত্বপূর্ণ’ এখানে গুরু হয়ে উঠার জন্য তিনি শুধু শিষ্যকে শেখান না, শিখতেও শেখান, ডিজিটাল সময়ের ভাষায় সফটওয়ের শুধু চলানো শিখান না, সফটওয়ের তৈরি করার কৌশলও শেখান, শুধু সফটওয়ের চলানোর দক্ষতা দিয়ে শিক্ষার্থী সফলতার শীর্ষে বা তাদের নিয়ে দেশ উন্নয়নের চূড়ায় পৌঁছতে পারে না। উন্নয়নের গতি তরান্বিত করা যায় না। তাই প্রকৃত শিক্ষক কোন বিষয় রপ্ত করায়ে শুধু দেন না,রপ্ত করার কৌশলও শিখিয়ে দেন, যেন নতুন বিষয়ের সমস্যা শিক্ষার্থী নিজ তাড়নায় সমাধান করতে পারে, নিজে নিজেই শিখতে পারে,সেই শিখন কৌশল শেখা থাকায়। এখানেই শিক্ষকের বড় কৃতিত্ব, বড় সফলতা । এতে শিষ্যের জানার ও সৃজনের স্পৃহাও বেড়ে যায়। গুরু বিষয়টি কিভাবে শিখতে হয় তার কৌশলটাও শিষ্যের ভিতর থেকে জাগিয়ে তুলেন। তখন সেই শিষ্য শুধু তাঁর গুরু থেকে শুধু শিখেন না, তাঁর গুরুর দেখানো পথে নিজে নিজে শিখে চলে। এই শিখতে চলার পথ কখনো শেষ হয় না। জীবন ব্যাপী শিখে শিখেও তার জ্ঞান অর্জন স্পৃহা থামে না বরং জ্ঞান তৃষ্ণা বেড়েই চলে। সেই তৃষ্ণার্ত মানিসিকতা তখন এক সময় সৃজনশীল না হয়ে পারে না। তৈরি হয় নতুন গন্তব্যের।
তাই শেখানোর পাশাপাশি শিখতে শেখানোটা গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা হলো এখানেই যে আমরা শিখাতে যেভাবে আগ্রহী সেভাবে শিখতে শেখানোতে আগ্রহী না। যার জন্য দেশের মধ্যে আমরা মানুষ গড়ার ‘কারিগরই’ থেকে গেলাম শিল্পী হতে পারলাম না। পারব কেমন করে শিল্পী হয়ে উঠার জন্য একজন শিক্ষককে যে ধৈর্য থাকতে হয়, যে সাধনা করতে হয় আমাদের সমাজে তা করা সম্ভব না, সেই সুযোগ কম, থাকে না। কেননা এই দেশের শিক্ষক সমাজকে বইপুস্তকে মর্যাদার আসনে রাখলেও আর্থিক সক্ষমতায়, সামাজিক সক্ষমতায় এগিয়ে রাখে নাই। এতে তাঁর মানসিক উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। আর্থিক টানাপোড়নে ও সামাজিক মর্যাদার নানা জটিলতায় তিনি স্থিরতা ও ধৈর্য ধরে রাখতে পারেন না। শিক্ষকতা যে সাধনার পথ, একনিষ্ঠ থাকার পথ সে পথে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে থাকা সম্ভব হয় না। এই সম্ভব না হওয়াটা শিক্ষা তলিয়ে যাওয়ার একটি কারণ। অন্যদিকে যিনি অর্থপীড়ন ও সামাজিক মর্যাদার নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন বলে তিনি হয়তো জীবিকার তাগিদেই শিক্ষক হতে পারেন। সৃষ্টিশীল হতে পারেন না। শিখতে শেখানোর জন্য, সৃজনশীল হওয়ার জন্য যে শ্রম ও আন্তরিকতা থাকা দরকার তা করা ও দেখানো সম্ভব হয় না। এখানেও আমাদের শিক্ষার মানবাড়ার অন্তরায় তৈরি হয়। শিক্ষার যে মূললক্ষ্য শিক্ষার্থীকে জাগিয়ে তোলা, তার মধ্যে জ্ঞান স্পৃহা বাড়িয়ে দেয়া, জানার পরিধি প্রসারিত করা, মানসিক দীনতা কাটিয়ে উঠার প্রেষণা যোগানো ইত্যাদি হয়ে উঠে না। এতে শিক্ষার মূললক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হয়। হয়তো তখন সাধনা ও শ্রমের পথের চেয়ে পুস্তকের নির্ধারিত পাঠটি শিক্ষার্থীকে শিখানোতে স্বস্তি পান। আর শিক্ষার্থীও ভাল পাসের সনদ দিয়ে চাকুরি একটা জুটিয়ে নেয়। এমন শিক্ষার্থীর দৌড় কতটুকুবা আর হবে। এখানে শিক্ষক আত্মগ্লানিতে ভোগতে পারেন, তাঁর মতো করে শ্রম দিতে না পারায়, আন্তরিকভাবে সাধনা করতে না পারায়।
এভাবে দুষ্টুচক্রের মধ্যে আমদের শিক্ষা আটকে পড়ে যায়। তাই আমদের শিক্ষা কার্যক্রমটা শুধু শিখানোটা দিয়ে চলমান থাকে, উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হয় না। এতে শিখন শেখানোটা গৌন হয়ে থেকে যায়। যার পিছনে নানা কারণ আছে। যেমন কারণ থাকুক না কেন, চলমান থাকলে তো হবে না। শিক্ষায় উৎপাদশীলতা ধরে রাখতে হয়, না পারলে শিক্ষা অনুর্বর হয়ে পড়ে। আর যে দেশে শিক্ষা অনুর্বর হয়, উৎপাদনশীল হতে পারে না সে দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না, সম্ভব হলেও ধরে রাখা যায় না। শিক্ষার্থীর অনুপাতে যেখানে একজন শিক্ষকের ক্লাসে ২০ জনের অধিক শিক্ষার্থী না রাখার আন্তর্জাতিক নিয়ম, যেখানে শিক্ষককে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সর্বোচ্চ মর্যাদায় রাখার কথা, অর্থপীড়ন থেকে মুক্ত রেখে শিক্ষকের জীবন স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাখা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তা সম্ভব না হলে সেখানে শেখানোর চেয়ে শিখতে শেখানো গুরুত্বপূর্ণ হলেও কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব তা ভাবার বিষয়। তবে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও যে সকল শিক্ষক শিখতে শেখানোতে সফলতা দেখাতে পারছেন সেই সব শিক্ষাগুরু প্রাতঃস্মরণীয়। আমাদের দুর্ভাগ্য সেই ধরণের শিক্ষাগুরুর সংখ্যা দিন দিন আমাদের সমাজ থেকে কমে যাচ্ছে,বা সেই ধরনের শিক্ষাগুরুর ধারণ আ ক্ষমতা সমাজের কমে গেছে বা সেই ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। তাই শিক্ষাকে আমাদের প্রত্যাশিত মানে পৌঁছাতে পারছি না
শিক্ষা কোন জড় বিষয় নয়। শিক্ষা প্রতিনিয়ত আবিষ্কার, প্রতিনিয়ত সৃষ্টির ভিতর দিয়ে শিক্ষা সজীব থাকে। তাকে সজীব রাখতে তা অর্জনের কৌশল জানা থাকা চাই। তাই শিক্ষার মানের স্বার্থে, জ্ঞানমুখি প্রজন্ম তৈরির স্বার্থে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে প্রজন্মদের ধরে রাখতে পারার জন্য শিখানোর পাশাপাশি শিখতে শেখানোর প্রতিও আরও মনোযোগ দেওয়া জরুরি। যা মানসম্মত শিক্ষায়ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
অধ্যক্ষ- খলিলুর রহমান মহিলা (ডিগ্রি) কলেজ