বাবুল কান্তি দাশ
তথ্য প্রযুক্তির উর্দ্ধায়ন, ডিজিটালাইজেশন বিশ্বায়নের যুগে নিত্য হাঁসফাঁস করছে অভিভাবক শ্রেণি। সন্তানদের নিয়ে বড্ড উদ্বিগ্ন অভিভাবক সমাজ। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কিলবিল করছে আমরা কি এগুচ্ছি নাকি নিকষ কালো অন্ধকারে পতিত হচ্ছি। ঊনবিংশ শতাব্দীর স্বর্ণখচিত সময়, বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ক্ষেত্র হিরন্ময় পুরুষদের যে জয়জয়কার একবিংশ শতাব্দীতে এসে তা যেন পুরোপুরি নিষ্প্রভ। ক্ষেত্রমতে হোঁচট খাচ্ছে! মূল্যবোধের চেতনা সৃজনশীল মননশীল কর্মোদ্দীপনা, বিবেক-মনুষ্যত্ব-মানবিকতা, ত্যাগ-সেবা -দান, পরোপকারীতা, সহযোগ-সহভাগে সপারিপার্শ্বিক বাঁচা-বাড়ার উদ্দীপনা কেমন জানি যাদুঘরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিদ্যা হচ্ছে শিক্ষা হচ্ছে না, দিব্যজ্ঞানের পরিধির বিস্তৃতি ঘটছে কান্ডজ্ঞান পলে পলে সংকুচিত হচ্ছে। সকল ক্ষেত্রে ভোগের দুর্দমনীয়তা, অতৃপ্তি, সঞ্চয়োন্মাদনা গ্রাস করছে সভ্যতার বিকাশ বর্দ্ধনা সৌন্দর্যের নান্দনিকতা। ফলস্বরূপ সমাজে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে ফাঁপা মানুষের। সংযম নিয়ন্ত্রণ হাবুডুবু খাচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা ও ভোগে। সন্তান-সন্ততির এহেন মানসিকতা খুব ভাবিয়ে তুলছে পিতা-মাতাদের। আজকের প্রজন্ম নিজেদের নিয়ে সবিশেষ ভাবিত হলেও অন্যের সম্পর্কে তারা মোটেও ভাবিত নয়। আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষণের মধ্যেই তাদের বিচরণ। সমাজের প্রতি বৃহত্তর কোনো দায়বদ্ধতা নেই তাদের। পারস্পরিক সম্পর্ক সমূহ বিভিন্ন সম্পর্কসূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জন একাকিত্বের দিকে চলে যাচ্ছে। যা এখন অন্যতম উদ্বেগের কারণ। এই নির্জনতা অথবা বিচ্ছিন্নতাবোধ সামাজিক কর্তব্যবোধের পুরো উল্টো। মূল্যবোধের তাড়না এবং দায়বদ্ধতার ইতিহাসে অভ্যস্ত সমাজ এই রকম নির্জনতাকামী জীবন দেখলে অস্বস্তি বোধ করে। ফলস্বরূপ সমাজের এক অংশ অন্য অংশের জন্য লজ্জাবোধ করতে আরম্ভ করছে। একা একা শুধু নিজের জন্য কাজ করে যাওয়ার মধ্যে কোথায় যেন এক ধরনের হীনতা আছে। অন্যদিকে দায়বদ্ধতা আত্মপ্রত্যয় ব্যক্তিমানুষের নির্জন স্বাতন্ত্র্যকে ছাপিয়ে গিয়ে নিজেকে সমূহের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার পরমার্থিক সংযোগের স্বর্গীয় সুখানুভূতি লাভের সুযোগ বিদ্যমান। সহযোগে সহভাগে পথচলায় পরমানন্দের তৃপ্তি। আমাদের শেখায়, “দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ”। অথবা পারস্পরিকতা, সহযোগিতার আত্মগরিমা – “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে”। আজ এই চেতনার বিস্তরণ ঘটাতে আমরা ব্যর্থ নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে মজে থাকা মানসিকতার কারণে। চারদিকে তাই আজ সরব হয়ে উঠেছে মূল্যবোধ শব্দটি। প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে হা-হুতাশ এর ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে। সনাতনী মূল্যবোধ আর আধুনিক মূল্যবোধ মারপিট করছে মাঠে-ময়দানে। যে মূল্যবোধ শুধু অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে বয়ে যাওয়া ছিল নিয়তি তা আজ ক্ষীয়মান এবং বিরুদ্ধ ভাবনায় আহত। মূল্যবোধ শুধু গ্রহণ ও লালনের বিষয় ছিল এতকাল, এখন তা প্রদান, প্রসার ও বর্জনেরও বস্তু হল। সমষ্টির কল্যাণের জন্য ব্যক্তি ও পরিবারের সুখের বিসর্জন যা আজ অকল্পনীয়। মূল্যবোধের উৎকর্ষ ছিল যখন পেয়েছি ঘরে ঘরে চৈতন্য পুরুষ, প্রাজ্ঞ ও মহৎপ্রাণ ব্যক্তি। পেয়েছি স্বাধীনতা, নিচ্ছি মুক্তির স্বাদ। আজকের প্রজন্ম সেদিক থেকে আরো অগ্রসর। তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে বিশ্ব আজ তাদের হাতের মুঠোয়। মাথাভর্তি মগজ, চমৎকার ভবিষ্যতের হাতছানি। কিন্তু কোথায় যেনো ছন্দপতন। চির ধরছে মা বাবার আশা আকাঙ্খা স্বপ্নে। নবীনরা অনেক কিছু জানে যা ওদের বয়সে আমরা কল্পনাতেও ধরতে পারিনি। কিন্তু আজ আমরা বিপর্য্যয়ের আশংকায় আতংকিত। গেল গেল রব। খাপছাড়া আমাদের মনোযোগ। রাজনীতিকরা এদের ব্যবহার করছে কায়েমি স্বার্থ হাসিলে। সাময়িক উন্মাদনার হাতছানি কিশোরদের বই ছেড়ে সামিল করছে মিছিলে। কোথাও কোথাও রুজি রোজগারে। কারো ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। জড়িয়ে পরছে নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপে। মেধার বিনষ্টি ঘটছে পলে পলে। এহেন মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সমাজতাত্তি¡করা উদ্বিগ্ন, অভিভাবকরা চিন্তিত। মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা জরুরি। পদ, ক্ষমতা, সঞ্চয়োন্মাদনার মোহ পরিহার করতে হবে নবীনদের স্বার্থে। শাসন সোহাগের অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে সমানতালে রাজনীতিক এবং অভিভাবকদের। দিতে হবে শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত পরিবেশ।উন্মুক্ত মাঠে অবাধ বিচরণ। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যের আবহ ও মূল্যবোধ। নিজ নিজ কৃষ্টি সংস্কৃতি ঐতিহ্যের চেতনা। শেকড়ে প্রবিষ্ট করে শিখরে নিয়ে যাওয়ার সংঘবদ্ধ প্রয়াস। বিনষ্টি থেকে নবীনদের রক্ষায় যতœবান হই, শান্তি স্বস্তির আবাস গড়ি। বহুল শ্রুত – পশু পশুত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু মানুষ মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। তাঁকে তা অর্জন করতে হয়। এই অর্জনে মানুষ হয়ে উঠে মান-হুঁশ। মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচায়ক হচ্ছে -দুর্বলকে রক্ষা করা আর দুর্জনকে বিনাশ করা। কিন্তু মনুষ্যত্বের বিকাশে মনোযোগী না হওয়ায় এবং ব্যাহত হওয়ায় মানুষ মানুষের কাছে গৃহপালিত পোষা পশুর আদরও পায় না। প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্ব›িদ্বতা যেখানে তা প্রাকৃতিক নিয়ম কিন্তু তা আজ ক্ষমতার দাপট আর পেশীশক্তির কাছে ম্রিয়মাণ। দেহে ক্ষীণ বুদ্ধিতে হীন ব্যক্তিরা শত অনুগত থাকার পরও তা’দের উপর শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন ঐ সকল ক্ষমতাবান ও পেশীশক্তির আত্মপ্রসাদ লাভের উত্তম পন্থা। বুদ্ধিমানরা এদের ছলে বলে কৌশলে নিয়ত বিব্রত বিভ্রান্ত প্রতারণা করে যাচ্ছে। সাথে সাথে সেই সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে আমাদের মননে অপরিপক্ব সন্তানদের উপর। যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কখনো শুভদায়ক হতে পারে না। সমাজে শান্তিতে সহাবস্থান ঐসকল বুদ্ধিমান শক্তিমান ক্ষমতাবানদের চক্ষুশূল। বিভাজন বৈষম্য এদের সাধনা। সিদ্ধি তাই অস্থিরতা অরাজকতা বিশৃঙ্খলা। সমাজে এখন প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয়ী অহং সচেতন এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের। যা সম্ভব প্রকৃত সুশিক্ষায়, সুশাসনে এবং বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থায়। মানবপ্রীতি সদাচার সহাবস্থান ব্যতিরেক সমাজ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা সংরক্ষিত হবে না। সহযোগে সহভাগে সপারিপার্শ্বিক পথচলা হোক মানবচরিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। সুবিধার ডাকে নয়, সত্যের ডাকে সাড়া দিই। আলোকিত হই।সমাজকে করি সমৃদ্ধ, দেশকে করি উন্নত। সুবিধা আজকের, সত্য চিরকালীন। সুবিধা সংকোচনের, সত্য সম্প্রসারণের। সুবিধাবাদী বিধ্বস্ত ও ধ্বংসের কারণ। সত্যবাদী সৃজন মননে সুন্দরে উদ্ভাসিত পথপ্রদর্শক। সুবিধাভোগী, সুবিধাবাদী সামাজিক অস্থিরতার কারণ। সত্যবাদী সামাজিক স্থিতিশীলতার দৃষ্টান্ত। আদর্শপ্রানতায় নিমগ্ন থেকে সংযম নিয়ন্ত্রণে পথচলায় জীবনের সার্থকতা নিহিত। সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষ আলাদা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। শুধুমাত্র বিচার বিবেচনা বিশ্লেষণ পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিমিত্ত মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষের মঙ্গলের উপর দাঁড়িয়ে তা’রই উৎকর্ষ অনুধাবনে বাস্তবভাবে নিজের জীবন যাপনাকে কেমনতর সচ্ছল ও সমুন্নত করে তুলতে পারি, আমার সহজ বোধকে তারই পরিচালনায় ন্যস্ত করে কাজে তাই করতে থাকি-সফলতা আসবেই। চাহিদা ভোগ দুর্ভোগ এসকল শব্দগুলো অর্থশাস্ত্র ও অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে ব্যাপক। যা আমার অতি ক্ষুদ্র বোধে বিবৃত করা পঙ্গুর গিরি লঙ্ঘনের সামিল। শুধুমাত্র সহজ সরল বোধের নিরিখে দু’একটি কথা বলার ব্যর্থ চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছি। ধর্মশাস্ত্র বলছে সীমালঙ্ঘনকারীকে স্রষ্টা পছন্দ করেন না। এবং যার সম্পদ যত কম হাসরের ময়দানে তার বিচার তত স্বল্প। যদি তা বোধে নিয়ে তদনুগ চলনায় প্রবৃত্ত হই তাহলে লাভ করতে পারব স্বর্গীয়সুখ। শরীর মনকে সুস্থ সুন্দর রাখার আমাদের যে লক্ষ্য তা সম্ভব ভোগকে দমন করার মধ্যে। ভোগের দুর্দমনীয়তা উসকে দেয় অনৈতিকতা। কুপ্রবৃত্তির মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ি। মানবজীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হই। ভোগ যদি হয় নিয়ন্ত্রিত, সীমাবদ্ধ তাহলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র হয়ে উঠে পরম শান্তি ও স্বস্তির আবাসস্থল। মানুষগুলো হয়ে উঠে স্নেহ প্রীতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আত্মার আত্মীয়। পেয়ে থাকি সহযোগে সহভাগে চলার প্রেরণা। সপারিপার্শ্বিক বাঁচা বাড়ার চেতনা। আমরা যদি শৈশব থেকেই সে অভ্যেস গড়ে তুলি এবং তা পালনে সপরিবার সচেষ্ট হই তাহলে অন্য এক আনন্দে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সুশৃঙ্খল হয়ে উঠবে। সন্তানদের একটুকরো মাছ, একটুকরো মাংস বা স্বল্প আহারে অভ্যস্ত করে তুলতে পারি, সহজ সরল জীবনবোধ জাগিয়ে দিতে পারি, মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা থেকে নিবৃত্ত রাখার শিক্ষা দিতে পারি পরিবার সমাজে বিরাজ করবে স্বর্গসুখ।আমরা যখন সুখের কামনা ভুলে গিয়ে নিজেকে দুঃখের জন্য প্রস্তুত করে তুলব তখনই সত্যিকার সুখ আমার কাছে ধরা দিবে অনায়াসে। দুঃখও একরকম ভাব, সুখও একরকম ভাব। অভাবের বা চাওয়ার ভাবটাই দুঃখ। আর এই দুঃখ কিন্তু কারো প্রকৃতিগত নয়। ইচ্ছে করলেই তা’কে তাড়িয়ে দিতে পারি। হৃদয়ে যখন দুর্বলতা আসে, ভয় আসে, আনন্দের খাকতি হয়, আর তখনই তা দুঃখ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। অতিমাত্রায় ভোগের স্পৃহা সেই দুঃখ ডেকে আনে অবলীলায়। দূর্বিষহ হয়ে উঠে ব্যষ্টি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন। খেয়াল রাখি, আমি যদি কারো দুঃখের কারণ না হই, তাহলে কেউ আমার দুঃখের কারণ হবে না। ভোগের নিমিত্তে সম্পদ আর প্রাচুর্যের আতিশয্যে জীবনকে পশুর মতো উপভোগ করা এবং বেঁচে থাকার চাইতে দুঃখকে সঙ্গী করে মানুষ হিসেবে মরে যাওয়া অনেক শ্রেয়। পানির থেকে আমরা শিখতে পাই স্বচ্ছতা, স্নিগ্ধতা, মধুরতা। পানি যেমন নির্মল করে, শুদ্ধ করে তেমনিভাবে আমরাও যেন দর্শন, স্পর্শন এবং মানুষের গুণগান করে সমাজ, রাষ্ট্র সর্বোপরি বিশ্বভূবনকে পবিত্র করে তুলি। যাদের জীবনে তথাকথিত ভোগের স্পৃহা নেই, দুঃখ মনে করে তারাই শুধু পারে জীবনকে ষোলো আনা উপভোগ করতে। জীবনকে তারা ফাঁকি মনে করে না, যা করে ধনীরা, ভোগীরা। ভোগকে নিয়ন্ত্রিত করে সুস্থ সুন্দর পরিবেশ রচনা করি। কবি বাইরন এর কথায় – ‘যে আনন্দ নিয়ে যায় কাল, কভু নাহি দেয় তাহা ফিরে, যৌবনের ভাবের গরিমা ডুবে যায় কাল-সিন্ধু-নীরে।’ মানুষের মূল শেকড় নিজেকে মান-হুঁশ হিসেবে গড়ে তোলা, মানুষের সেবায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখা। তাহলেই মনুষ্য জন্মের সার্থকতা।
নিজ নিজ প্রয়োজনে অন্যজনের সেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। মানুষের সেবা করা এবং তা’তে আমার আনন্দ হওয়া, প্রীত হওয়া সে এক স্বর্গসুখ। যখন এমনতরো অনুভূতি মানুষের মাঝে সৃষ্টি হবে তখন কিন্তু জীবনের আদলটাই পাল্টে যাবে। মানুষকে সেবা দিতে শুধু অর্থ বিত্ত ধন দৌলত প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। আমি চাইলে বিভিন্নভাবে মানুষের সেবায় নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারি। কথা বলে, নিজেকে পরিশীলিত করে ঐ পথে চলার আমন্ত্রণ জানিয়ে, উদ্দীপ্ত করে, শক্তিসমৃদ্ধ করে, মেধা দিয়ে সর্বোতভাবে মানুষকে যোগ্য করে তুলতে সচেষ্ট থাকাও কিন্তু সেবা।বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষকে আপন করে তোলা, বান্ধব করে তোলা এ বড় কম যোগ্যতার কথা নয়।এতে করে মানুষের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, অনিসন্ধিৎসু সেবাবৃদ্ধি বেড়ে যায়, পর্য্যবেক্ষণশক্তি বেড়ে যায়, নিয়ন্ত্রণ-কৌশল বেড়ে যায়, কর্মশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি বেড়ে যায়, হৃদয় প্রসারিত হয়। তখন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠে। সকলের তরে সকলে হয়ে উঠে। পরিপালন পরিপোষণ মুখ্য হয়ে উঠে। স্বার্থপ্রত্যাশারহিত হয়ে যখন মানব হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে মানুষের সেবায় মুখর হয়ে উঠে তখন পরস্পর পরস্পরের জীবনীয় হয়ে দাঁড়ায়। অনেকের ধারণা সেবা দিতে অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু কেমন করে তা আসে তা আর দেখে না। অর্থ আসে সেবার ভিতর দিয়ে। সেবাস্বার্থী হলে মানুষের কর্মের বিস্তৃতি ঘটে, দক্ষতা বিবর্ত্তিত হয়। মানুষকে বাঁচাবার জন্য অন্তরে স্বর্গীয় আনন্দের উৎসরণ ঘটে। এহেন আনন্দের তরে হাজী মুহাম্মদ মহসিন, মাদার তেরেসা, রণদা প্রসাদ সাহা মানুষের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। বাঁচা বাড়ার নামই ধর্ম। ধর্ম লোককল্যাণ ও লোকসেবার জন্য পালন পোষণ। সেবা শুশ্রূষায় সপারিপার্শ্বিক বাঁচা বাড়ায় আত্মনিয়োগ মানব জীবনের সার্থকতা। মানুষ যদি হই মানুষের পাশে, মানুষের সেবায় পথ চলে মহিমান্বিত করতে হবে মানব জন্মকে। সবকিছু ধর্ম হলেও সেবা কিন্তু পরম ধর্ম। মানব কল্যাণে মানুষের জীবন। জীবনের কল্যাণে নিবেদন গুণই মানুষের মানবিকতা। মানুষ মানুষের উপকার করতে পারে হৃদয়ের ভালবাসা দিয়ে। একমাত্র মনের ভাব প্রকাশ করার মধুর বাক্য মানুষেরই রয়েছে। মানুষের মানবিক গুণাবলী দিয়ে পৃথিবী জয় করতে পারে অতি সহজে। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা। পৃথিবীতে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষুধা আর লজ্জা নিবারণের জন্য মানুষ হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্ন ও বস্ত্র পুনঃ পুনঃ দরকার হয় জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য। ক্ষুধার কষ্ট পৃথিবীতে কোন প্রাণী সহ্য করতে পারে না। একমাত্র জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কতটা হানাহানি, মারামারি, দ্ব›দ্ব, সংঘাত মানুষের হিংস্রতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই কবির ভাষার বলতে হয়, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।’ মানুষ হয়ে মানুষের সেবায় যদি নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে না পারি তাহলে মানবজীবন বৃথা। বিত্ত-বৈভব, শিক্ষা-দীক্ষা যদি মানুষের সেবায়, মানবতার বিকাশ ও বর্দ্ধনায় না লাগে তাহলে তা যথার্থ অর্থে ব্যর্থ। বিশ্বে মানবতা ও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখা যায় সূর্যোদয়ের দেশ জাপানকে।জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে গড়ে উঠা ছোট্ট একটা দ্বীপ।জাপানের শিশুদের শিক্ষা, কঠোর পরিশ্রম, প্রবল আত্মসম্মানবোধ, অপরকে সহযোগিতা করার মনোভাব তাদেরকে উন্নত জাতিতে পরিণত করেছে। শিশুদের বোধ শক্তি জাগ্রত হওয়া থেকে তাদের শিশু মনে গেঁথে দেয়া হয় গুরুজনদের সম্মান করা, মানুষের কল্যাণে কাজ করা,মানুষের সেবা করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশ সুরক্ষা, সবুজায়ন, বৃক্ষ পরিচর্যা, বড়ো হয়ে নিজেকে সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত করা, আর্দশ নাগরিক হওয়া, মানবিক মূল্যবোধ সর্বোপরি সৎ ও সততার মাধ্যমে জীবন যাপন করা। এখানে উল্লেখ যে, টাইটানিক জাহাজ ডুবি থেকে যে কয়জন জাপানি বেঁচে ছিলো, দেশে ফিরে তাদের প্রবল জনরোষের সম্মুখীন হতে হয়, ‘সহযাত্রীদের বাঁচাতে যদি নাই পারলে তবে তাদের সাথেই প্রাণ কেন দিলে না’। এই ছিলো জাপানি আপামরজনতার আক্ষেপ। এতে বুঝা যায়, দেশপ্রেম মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ, সেবা, দায়িত্ব কতখানি প্রবল। তাই বিশ্বে মানবতার কাজে আত্মনিবেদনে জাপান বহুলাংশে এগিয়ে। অতিক্ষুদ্র একটি বীজ থেকে বটবৃক্ষের মত মহীরুহের জন্ম। আমরা যদি কারো ছোট্ট একটা গুনকে সেবা যত্ন করি, তাহলে মানব সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে তার থেকে অনেক বড় কিছু আশা করতে পারি। গোলমালের এই জগত থেকে গোলটা বাদ দিয়ে মালটা তুলে নিতে চেষ্টা করি। প্রযুক্তিকে ভালোর জন্য ব্যবহার করি, চারদিক আনন্দময় হয়ে উঠবে। এক পৃথিবী, এক মানুষ, এক তার মানবতাবোধ। লিঙ্গ, ধর্ম, গোত্র, জন্ম পরিচয় বিবেচ্য বিষয় নয়। সে শুধু ‘মানুষ’। মানুষই তার পরিচয়। এই বিবেচনা বোধই একজন অন্যজনের পাশে এসে দাড়াঁবে বিবেকের তাড়নায়। জাগ্রত বিবেক স্থান , কাল , পাত্র দেখে না। সে সর্বদা জাগ্রত। সবার প্রতিই তার সমান দৃষ্টিভঙ্গি।তাই স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় – ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গান -’ মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য….
মানুষের জন্য, মানুষের সেবার জন্য করাই হচ্ছে আমাদের শেকড়। সেই শেকড় ভুলে অন্য যা কিছু তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে অতি নিশ্চিত। তাই মানুষের সেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে মানবজনম সার্থক করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক