অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব
আমাদের দেশে শিক্ষায় সফলতার প্রধান ফোকাস গড়ে উঠেছে পরীক্ষাকে ঘিরে। পরীক্ষার অভিক্ষায়/প্রশ্নে যা চাওয়া হয় বা জানতে চায় তার জন্য আমরা অভিভাবকরা যেমন আধা জল খেয়ে নামি আবার প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সংশ্লিষ্টদেরও ভারি ভারি উপদেশনা ও নির্দেশনার প্রাবল্যতায় পরীক্ষার্থী মানসিক চাপে পড়ে যায়। এই সবকিছু পরীক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে উপায় নেই। যার জন্য মানসিক অসুস্থতা নিয়ে পরীক্ষার কক্ষে প্রত্যাশিত মাত্রায় মস্তিষ্ক কাজ করতে পারে না। এতে নানা রকম অসুবিধায় পরীক্ষার্থীকে পড়তে হয়। এখানে অনেক অভিভাবকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমাদের সময় তো এমন হতো না এখন কেন আমরা পরীক্ষার্থীকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি। তার কারণ আগে আমাদের পরিবার ছিল যৌথ, মা-বাবার সন্তান সংখ্যা ছিল বেশি। ফলে মা-বাবার সন্তান বাৎসল্যতা ও আবেগ-ভালোবাস-স্নেহ বহু সন্তানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় বা ভাগ হয়ে যাওয়ায় প্রতি সন্তানের উপর এই সবের ভাগ কমে যায়, চাপ কমে যায়। এতে সন্তানের নিজস্বতা বা স্বকীয়তা গড়ে উঠার সুযোগ থাকে, আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠার ক্ষেত্র বজায় থাকে। ফলে সন্তান তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র থেকে তার মত করে জ্ঞান তৈরি করতে পারে। মা-বাবার অভিজ্ঞিতার জগতের চাপ নিতে হয় না।
মা-বাবার বহু সন্তান থাকলে সন্তানদের মধ্যে গড়পড়তা প্রতি সন্তানের জন্য উদ্বেগের প্রাবল্যতার প্রখরতা কম হয়। একমাত্র সন্তান হলে ঘুম থেকে দেরি করে উঠলেও তার জন্য মা-বাবার কপালে ভাঁজ পড়ে, ভয়ে বুক কেঁপে উঠে। আগ্রহ বেশি থাকায় তার উপর মনোযোগের তীব্রতা প্রখর হয়ে উঠে বলে। অন্য দিকে চাপমুক্ত পরিবেশে সন্তানের মানসিক স্বস্তির কারণে শান্ত থাকে মস্তিষ্ক। নিজের মত করে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকে, পেরে উঠার ক্ষেত্র বজায় থাকে। ফলে সন্তান তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার বিকিরণ দিয়ে পড়া আয়ত্ব করতে পারে বলে তা তার জন্য বোঝা না হয়ে সম্পদ হয়ে উঠে। তার মত করে জ্ঞান তৈরি করতে পারে বলে সে জ্ঞান কাজে লাগাতে পারে। মা-বাবার সময়ের অতীতের অভিজ্ঞিতার মুখোমুখী হতে হয় না।
একটি অভিজ্ঞতার বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায়। মেয়েকে আমার পরিস্থিতির কারণে স্বনাম ধন্য একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে হলো। লেখাপড়ায় এগিয়ে থাকার নিশ্চয়তার জন্য মনে হয়। তাই কলেজের ভর্তি পরীক্ষার পাঁচ/ছয় দিন আগে কোচিং সেন্টারটির প্রশংসা করে স্বহস্থে লিখিত মেয়ে থেকে একটি প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে রাখল, আর কোচিং পরিচালক ও শিক্ষকদের গুণকীর্তন করা একটি ভিডিও ক্লিপও তৈরি করে নিল। মেয়ে যদি প্রতাশিত কোর্সে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তা হলে মেয়ের দেওয়া প্রত্যয়ন পত্র ও ভিডিও ক্লিপটি কোচিং সেন্টারটির ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে কাজে লাগানো যাবে। এতে আমার মেয়ের মানসিক চাপ বেড়ে যায়। যদি ভর্তি পরীক্ষায় না টিকে থাকি!
এভাবে নানা চাপ নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গেলে পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র পড়ে নার্ভাস হয়ে যেতে পারে পরীক্ষার্থী। যদি ভালো করে পরীক্ষা দিতে না পারে, নাম্বার কম পায় তা হলে তার পরিবার থেকে, আত্মীয় স্বজন থেকে, কোচিং গ্রুপ থেকে কী কী নেতিবাচক, ভিদ্রূপাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে তা মনের পর্দায় ভেসে উঠে। কল্পিত সেই নেতিবাচক ধারনার কারনে তার মানসিকতা অস্থির হয়ে পড়ে। মানসিক স্বস্তি নষ্ট হয়ে যায়। সৃজনশীল ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে তার মতো করে পরীক্ষা দেওয়া হয়ে উঠে না।
তাই মানসিকস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তা ডোম তৈরি করে রাখতে হবে। যাতে কোন অবস্থাতেই মানসিক উপযোগিতা না হারায়। সব ধরণের পরিস্থিতি সহযে মোকাবেলা করতে পারে। এই জন্য পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষার্থীকে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে যেতে হবে। স্বাভাবিক পরিবেশে যে পরিবেশে পরীক্ষার্থী অভ্যস্ত সেই পরিবেশে তাকে রাখতে হবে। কিছু অভিভাবক আছে যারা শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি কেমন হয়েছে, পরীক্ষার হলে যাওয়ার দিনেই নানা প্রশ্ন করে আর পরামর্শ দিতে থাকে। তারা মনে করতে পারে এতে পরীক্ষার্থী তার সন্তান তা শুনে মানসিকভাবে সক্ষম হয়ে উঠছে, প্রেষণা পাচ্ছে, পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সাবলীল হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে তা করা হয় অভিভাবক স্বস্তি পাওয়ার জন্য, সান্ত¦না পাওয়ার জন্য। এই সব করে আসলে আমরা পরীক্ষারদেরকে অসুবিধায় ফেলে দিই মাত্র।
পরীক্ষার্থীর মানসিকতা ভালো থাকার জন্য, স্বস্তিদায়ক হওয়ার জন্য, মানসিক উপযোগিতা নিশ্চিত থাকার জন্য কিছু বিষয়ের উপর মনোযোগ বাড়িয়ে দিতে হবে। বিষয়গুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো। পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর, উত্তর পত্রে কোন মতে লিখে দিতে পারার মধ্যেই সফলতা। এই ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য আরও কিছু বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে ও সেই সবের গুরুত্ব বোঝতে হবে। এই সব নিয়েই পরীক্ষা সফল হয়ে উঠে। সেই সব উপাদানগুলো হলো-
১) সময় নিষ্ঠতা-প্রথমত পরীক্ষার্থীর সময়নিষ্ঠতা থাকতে হবে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগেই পরীক্ষার হলে পৌঁছতে হবে। যাতে ঠিক সময়ের আগে পৌঁছতে না পারার দুশ্চিন্তায় না পড়তে হয়। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে যাতে তার মধ্যে কোন অস্থিরতা তৈরি না হয়।
২) মনোযোগিতা-মনোযোগিতা হলো সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্য কিছুকে গুরুত্ব না দেওয়া বা অন্য বিষয় সামনে না আন, এড়িয়ে যেতে পারা। এক্ষেত্রে প্রশ্ন পত্র হাতে আসার আগে ৫ (পাচঁ) মিনিট চুপচাপ থাকতে হয়। চোখ বন্ধ করে দশ (১০) থেকে ০১ (এক) পর্যন্ত গণনা করে শ্বাস লম্বা করে নাক দিয়ে নিয়ে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়তে হবে। এবং মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে হবে। এবার প্রশ্ন হাতে আসলে মনোযোগ দিয়ে ধীর স্থিরভাবে প্রশ্নটি পড়ে যেতে হবে। কমপক্ষে দুই বার পড়তে পারলে ভালো। প্রশ্ন ভালো করে পড়ে বোধে আনতে না পারলে পরীক্ষায় ভালো করতে পারাটা ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তাই প্রশ্ন ধীর স্থিরভাবে পড়ে প্রশ্ন বোঝতে হবে, এর জন্য একাগ্রতা ও মনোযোগ বেশি প্রয়োজন। তা থাকলে এই ঝুকিঁ কাটানো যাবে।
৩) উত্তর লেখার জন্য প্রশ্ন বাছাই করতে পারা- কোন প্রশ্নের পর কোন প্রশ্নের উত্তর লিখলে উত্তরপত্র মূল্যায়নকারির বা পরীক্ষকের নিকট পরীক্ষার্থীর ব্যাপারে ভালো ধারণা হবে তা বাছাই করতে না পারলে ঝুঁকি থেকে যায়। উত্তরপত্রে কাটা ছেড়া হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। তাই এই বিষয়ে পরীক্ষার্থীকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন বাছাই করতে হবে। এজন্য কোন প্রশ্নের উত্তরের পর কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে যাচ্ছে তা আগাম ধারণা করে রাখতে হয়।
৪) সময় সচেতনতা-পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে আসার পর প্রশ্নের উপরে লিখে দেওয়া বরাদ্দকৃত সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকতে পারাটাও পরীক্ষার্থীর জন্য জরুরি। তার পাশাপাশি বহু নির্বাচনী প্রশ্নের (এমসিকিউ) উত্তর দেওয়ার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের (৩০টির জন্য ৩০ মিনিট, বিজ্ঞানের ২৫ টির জন্য ২৫ মিনিট) ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। যাতে সময়ের সদব্যবহার করে প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে যেগুলোর উত্তর জানা থাকে ও সহজে দেওয়া যায় সেই সব প্রশ্নের উত্তর ১ম ধাপে দিয়ে দেওয়া উচিত। সৃজনশীল প্রশ্নের যে কয়টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে (বিজ্ঞানে ৫টি, সময় ২ঘণ্টা ৩৫ মিনিট, মানবিক/ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ৭টি, বরাদ্দকৃত সময় ২ঘণ্টা ৩০মিনিট) প্রত্যেক প্রশ্নের জন্য প্রয়োজ মত সময় বরাদ্দ করতে হবে। এই বরাদ্দকৃত সময় এর বাইরে ৫ মিনিট সময় জমা রাখতে হবে। যাতে উত্তর লেখা শেষ করে বরাদ্দ রাখা ৫ মিনিট দিয়ে উত্তরপত্র রিভাইজ দেওয়া যায়। এখানে উল্লেখ্য যে প্রশ্নের উত্তর লেখা শেষ হয় সেই প্রশ্নেই শুধু দাগ দিতে হবে। অগ্রীম বা না লিখে দাগ না দেওয়াই ভালো।
৫) ধৈর্য ধারণ করতে পারা- একাক্রমে ৩ (তিন) ঘণ্টা ধরে প্রশ্নের প্রতি, সময়ের প্রতি, উত্তর দেওয়ার প্রতি নিষ্ঠার সহিত মনোযোগ ধরে রাখতে পারার মধ্যে বড় যোগ্যতার প্রকাশ পায়। এই জন্য শান্তভাবে ধৈর্য ধারণ করতে পারাটা সফলতা অর্জনের পূর্বশর্ত। ধৈর্য ধরা তাই পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২৬ জুন হতে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। যতটুকু পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়েছে তা যত্ম করা ও ধীর স্থিরভাবে রিভাইজড দিয়ে মস্তিষ্কে সাজিয়ে রাখা হলো প্রধান কাজ। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে আগাম শুভেচ্ছা। তারা যদি উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেয় ও গুরুত্ব বোঝে তা হলে পরীক্ষা অবশ্যই ভালো হবে। বাহিরের বিষয়গুলোর চেয়ে নিজের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতিই পরীক্ষায় সফলতা নিশ্চিত করতে পারে। এব্যাপারে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রত্যেককে সচতন থাকতে হবে। তবেই আমদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা নির্বিঘেœ পরীক্ষা দিয়ে সফল হতে পারবে। দোয়া থাকল সবার জন্য।
লেখক-শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
অধ্যক্ষ- খলিলুর রহমান মহিলা ( ডিগ্রি) কলেজ