শুভ মহালয়া : মা আসছেন শান্তির বার্তা নিয়ে

1

বিপ্লব কান্তি নাথ

ওঁম সর্বমঙ্গলা মঙ্গল্যে, শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী, নারায়ণি নমোহস্তুতেঃ \

যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।
মাতৃ পক্ষের শুরুতে মায়ের আশীর্বাদে সকলের জীবন হোক সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরা। শুভ মহালয়া!
বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের পুণ্যলগ্ন শুভ মহালয়া। আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি থেকেই শারদীয় দুর্গাপূজার শুরু। তার পূর্বের অমাবস্যা তিথিতে মহালয়া। কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত পক্ষকাল পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধসহ তর্পণাদি করাই নিয়ম।
‘মহালয়া’ শব্দটির অর্থ মহান আলয় বা আশ্রয়। এক্ষেত্রে দেবী দুর্গাই হচ্ছেন সেই মহান আলয়। মহালয়ার দিন গঙ্গাবক্ষে দাঁড়িয়ে পূর্ব-পুরুষদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি দেওয়া বা তর্পণের রীতি রয়েছে। কালো তিল আর কুশ সহযোগে পূর্ব পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। বহু বছর ধরে বাঙালিদের কাছে মহালয়ার আরও একটা বিশেষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অনুকরণীয় কণ্ঠস্বরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান।
পঞ্চাঙ্গ অনুযায়ী এই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ২ অক্টোবর মহালয়া বা মহালয়া অমাবস্যা অনুষ্ঠিত হবে। অমাবস্যা তিথি শুরু হবে ১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ রাত ০৯:৩৯ মিনিটে এবং শেষ হবে ২ অক্টোবর ২০২৪ রাত ১২:১৮ মিনিটে। এবছর দেবী দুর্গার দোলায় আগমন এবং গজে গমন।

মহালয়ার তাৎপর্য ও ইতিহাস :
হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, দুর্গাপূজা উদযাপনের এক সপ্তাহ আগে মহালয়া শুরু হয়। এই শুভ দিনটি বিভিন্ন রীতিনীতি এবং আচার- অনুষ্ঠান দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। ভক্তরা ‘তর্পণ’ করেন, তাদের পূর্বপুরুষদের বিদেহী আত্মার কাছে প্রার্থনা করেন এবং ব্রাহ্মণদের ভোগের পাশাপাশি অভাবীদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করেন। অনেকে শ্রদ্ধেয় মহিষাসুরমর্দিনী রচনাও শোনেন, যা দেবী দুর্গার একটি ঐতিহ্যবাহী আবাহন।
মহালয়ায় বাঙালি পরিবারগুলি ভোরের আলো ফোটার আগেই জেগে ওঠে, দিনের আধ্যাত্মিক তাৎপর্যকে আলিঙ্গন করে। অনেক হিন্দু বাড়িতে, পিতৃ তর্পণ অনুষ্ঠান পালন করা হয়, যেখানে পরিবারগুলি পিন্ডদান নৈবেদ্যের মাধ্যমে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গঙ্গা নদীর তীরে জড়ো হয়।
এই মর্মস্পর্শী অনুষ্ঠানটি মৃতদের সম্মান জানায়, তাদের আশীর্বাদ ও শান্তি কামনা করে। দিনটি বাড়ার সাথে সাথে ভক্তরা প্রার্থনা, প্রতিফলন এবং দাতব্য কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করে, আসন্ন দুর্গাপূজা উৎসবের সুর তৈরি করে। এই চিরন্তন ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে, মহালয়া প্রজন্মের মধ্যে শাশ্বত বন্ধন এবং মন্দের উপরে ভালোর জয়ের মর্মস্পর্শী অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে।
পূরাণে কথিত রয়েছে, ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর মানুষ এবং দেবতাদের কাছে অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র কোনো নারীশক্তির কাছেই তার পরাজয় নিশ্চিত ছিল। ব্রহ্মার কাছ থেকে এমন বর পেয়ে দেবতাদের উপর মহিষাসুরের তান্ডব ক্রমশ বাড়তে থাকে। অসুরদের অত্যাচারে যখন দেবতারা অতিষ্ঠ। দেবতারা যখন স্বর্গচ্যুত তখন ত্রিশক্তি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর নারীশক্তির সৃষ্টি করেন। তিনি মহামায়ারূপী দেবী দুর্গা। দেবতাদের থেকে পাওয়া অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন দুর্গা। সেই জন্য যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস এই উৎসব অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভশক্তির প্রতিষ্ঠা করে। সকল অন্ধকারের পর আলো ফোটে।
মহালয়ার দিন দেবী দুর্গা কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে বাবার বাড়িতে আসছেন। শ্রদ্ধাভরে তিনি পূজিত হবেন মন্ডপে-মন্ডপে। চারদিকে উৎসবের আমেজ মায়ের আগমনী বার্তায়। মা আসছেন, মা আসছেন সকল অশুভ শক্তির বিনাশ করে শান্তির বার্তা নিয়ে।

দেবী ভাগবত পুরাণ অনুসারে :
দেবীদুর্গার মর্ত্যে আসা এবং কৈলাসে ফিরে যাওয়ার জন্য যে বাহন ব্যবহার করেন, তার বিচার করেই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কেমন হতে চলেছে তা বোঝা যায়। এ ক্ষেত্রে ৪টি বাহনে দেবীদুর্গা পৃথিবীতে আসেন এবং যান।
বাহনগুলো হলো-গজ (হাতি), ঘোটক (ঘোড়া), দোলা (পালকি) ও নৌকা। গজের পিঠে আসা ও ফেরা সবসময়ই শুভ বলে বিবেচনা করা হয়। মনে করা হয় আগামী দিনে পৃথিবী হয়ে উঠবে শস্য শ্যামলা। দোলায় হলে তা অশুভ ইঙ্গিত দেয়। এর অর্থ আগামী দিনে খরা, মহামারি অপেক্ষা করে আছে। ঘোটকে আসা খুব একটা শুভ নয়। এর অর্থ হলো বিপদ ও ধ্বংস বাড়বে। নৌকায় হলে তা ইচ্ছা পূরণের ইঙ্গিত দেয়। এর অর্থ হলো পৃথিবীতে শস্যের কোনো অভাব হবে না। একই সঙ্গে বন্যা হওয়ারও ইশারা করে এই বাহন।

লেখক : সংবাদকর্মী, সাধারণ সম্পাদক, রুদ্রজ ব্রাহ্মণ পুরোহিত সংঘ, বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় সংসদ