শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা

13

আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব। এই দিনটি বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক মহামতি গৌতম বুদ্ধ বা সিদ্ধার্থের জীবনের তিনটি ক্ষণের স্মৃতিতে ঘেরা। সিদ্ধার্থের জন্ম, বোধিলাভ ও মহাপ্রয়াণের সেই তিন ক্ষণ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে হয়েছিল বলে একে বৈশাখী পূর্ণিমাও বলা হয়।
চাঁদের হিসাব বলছে, আজ বুধবার (২২ মে) সেই বুদ্ধ পূর্ণিমা। এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বৈশাখের এমনই পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের লুম্বিনী কাননে রাজা শুদ্ধোদন ও রানি মায়াদেবীর গৃহে জন্ম হয়েছিল এক শিশুর। সিদ্ধি লাভ করবেন এমন ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়ে সাধকেরা তার নাম দেন সিদ্ধার্থ।
যৌবনে ঠিক এমনই এক পূর্ণিমা তিথিতে কেবল সিদ্ধি নয়, ভারতের বিহার রাজ্যের বুদ্ধগয়ায় বোধিপ্রাপ্ত হন সিদ্ধার্থ। নিজের অন্তর্দৃষ্টির কথা সবাইকে জানিয়ে জাগতিক সকল সত্তাকে পুনর্জন্ম ও দুঃখের সমাপ্তি ঘটাতে সাহায্য করার সম্পূর্ণ বুদ্ধত্ব অর্জন করেন। আবার ৮০ বছর বয়সে এমনই এক পূর্ণিমা তিথিতে জাগতিক মায়া ত্যাগ করে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন তিনি।
বৈশাখের সেই পূর্ণিমা তিথি ফের এসেছে ধরায়। বোধিপ্রাপ্ত সেই মহাপুরুষ গৌতম বুদ্ধের ত্রিস্মৃতিবিজড়িত হওয়ার কারণেই এটি বুদ্ধ পূর্ণিমা নামেই পরিচিত। সে কারণেই সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ তার বোধিলাভের পর মানবতার যে ধর্ম প্রচার করেন, সেই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের এটিই পবিত্রতম উৎসব।
শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে বুধবার সারাদেশে রয়েছে সরকারি ছুটি। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি বাণীতে বলেন, মহামতি বুদ্ধ একটি সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় আজীবন সাম্য ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করে গেছেন। ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ বুদ্ধের এই অমিয় বাণী আজও সমাজে শান্তির জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। আজকের এই অশান্ত ও অসহিষ্ণু বিশ্বে মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্ম-বর্ণ-জাতিতে হানাহানি রোধসহ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহামতি বুদ্ধের দর্শন ও জীবনাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণীতে বলেন, মহামতি গৌতম বুদ্ধ আজীবন মানুষের কল্যাণে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় অহিংসা, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছেন। শান্তি ও সম্প্রীতির মাধ্যমে আদর্শ সমাজ গঠনই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। বুদ্ধ সত্য ও সুন্দরের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবজগতকে আলোকিত করতে কাজ করে গেছেন। মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর জীবনাদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করা প্রয়োজন।
সিদ্ধার্থের জন্মের পরপরই ঋষি অসিত জানিয়েছিলেন, রাজা শুদ্ধোদনের এই পুত্র ভবিষ্যতে রাজচক্রবর্তী সম্রাট (সব রাজ্যের একাধিপতি) হবে, অথবা সারাবিশ্বকে জয় করে নেওয়ার মতো সন্ন্যাসী হবে। একমাত্র সন্তান যেন সন্ন্যাসে না ঝুঁকে পড়ে, সে কারণে প্রাচীরঘেরা প্রাসাদে তাকে বড় করেন শুদ্ধোদন। কিন্তু সিদ্ধার্থের গন্তব্যই ছিল বোধি। ভোগবিলাসে তাই একসময় বৈরাগ্য আসে তার। জন্ম ও জগতের স্বরূপ উন্মোচন করতে আচমকা এক রাতে স্ত্রী যশোধরা ও সদ্যোজাত সন্তানকে ছেড়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। সাধনায় রত হন। এক অশ্বত্থ গাছের তলায় টানা ৪৯ দিন ধ্যান করে লাভ করেন সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান বোধি।
গৌতম বুদ্ধ তার বোধিপ্রাপ্তির পর অষ্টাঙ্গিক মার্গের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মানুষকে। জানান এই আটটি নীতি পালন করা গেলে দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণা কখনো কাউকে গ্রাস করতে পারবে না। গৌতমের সেই অষ্টমার্গ হলো সম্যক দৃষ্টি বা জীবন সম্পর্কে সৎ ধারণা, সম্যক সঙ্কল্প বা সৎ জীবনযাত্রা, সম্যক বাক্য বা সর্বদা সত্য কথা বলা, সম্যক আচরণ বা অন্যকে দুঃখ না দেওয়া, সম্যক জীবিকা বা সৎ পথে অর্থোপার্জন, সম্যক প্রচেষ্টা বা লোকের ভালো করার প্রয়াস, সম্যক স্মৃতি বা সৎ চিন্তা এবং সম্যক সমাধি বা কাজে মনোযোগ।
মানুষে মানুষে সমানাধিকার, সার্বিক কল্যাণ আর সেবার নীতি নিয়ে গৌতম বুদ্ধের মন্ত্র ছিল ‘অহিংসা পরম ধর্ম’। সেই মন্ত্র আর অষ্টমার্গের মর্মবাণী ধারণ করে মানুষ আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠবে, মানুষে মানুষে হানাহানি বন্ধ হয়ে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হবে বুদ্ধ পূর্ণিমায় সেই দর্শনটুকু ছড়িয়ে পড়ুক মানুষের মাঝে।