শিশু শিক্ষা প্রেক্ষিত: অভিভাবকের ভূমিকা

2

এম এ ফয়েজ

শিশুরাই হচ্ছে প্রত্যেক পরিবার, সমাজ, দেশের তথা মানব জাতির একটি বিশাল অংশ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আজকের শিশুই একদিন বড় হয়ে সমাজ ও দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। মানুষ হয়ে দেশ ও দশের সুনাম বৃদ্ধি করবে। এজন্যই চাই শিশু মানসের সযতœ পরিশোধন, উপযুক্ত পরিবেশ ও উপযুক্ত শিক্ষা। রক্ত মাংস ও মনুষ্য অবয়ব বিশিষ্ট দেহ ধারণ করলেই মানুষ হয় না। মাতৃগর্ভ হতে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয় সে তখন একটি ফুলের মত পবিত্র, নিষ্পাপ, নিরপরাধ ও নিতান্ত অসহায় অবস্থায় থাকে। একসময় সে আস্তে আস্তে বড় হয়। তারপর আস্তে আস্তে সে কিছু কিছু শিক্ষা লাভ করে নিজেকে উপযুক্ত করে তোলে। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা বিহীন জাতির উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। আর তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন উন্নত করতে হলে চাই উপযুক্ত শিক্ষা।
একজন নেপোলিয়ন বলেছিলেন, মেহেদী পাতার বুকে যেমন লাল রং লুকিয়ে থাকে, তেমনি শিশুদের হৃদয়ের মাঝে এক অদ্ভুত সম্ভাবনাময় জাতি লুকিয়ে আছে।
সাধারণত : শিশুরা জন্মের পর নিতান্ত অসহায় অবস্থায় থাকে। তাদের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হয় এবং গড়ে উঠতে হয়। তাই প্রতিটি শিশুকে গড়ে তোলার প্রয়োজনে শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ শিশুর শিক্ষা লাভের জন্য বিদ্যালয় হচ্ছে একটি অভিনব মানুষ তৈরীর কারখানা। মানুষের জীবনে রয়েছে বিভিন্ন স্তর বা পর্যায়। যেমন- শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং বয়োবৃদ্ধ অবস্থা। শিক্ষা শিশুর সহজাত মেধা তথা গুণাবলীর বিকাশে সহায়তা প্রদান করে। মানব জীবনের বিভিন্ন স্তর বা পর্যায় বিবেচনা করে শিক্ষা কর্মকান্ডে স্তরবিন্যাস করা হয়।
শিক্ষার ব্যাপারে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সম্পৃক্ত। গৃহই শিশুর প্রথম পাঠশালা এবং মা-ই শিশুর প্রথম শিক্ষক এমন কথা-ই প্রচলিত এবং সমাজে স্বীকৃত। বিদ্যালয়ে
নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জ্ঞানদানে তথা জ্ঞান চর্চায় সহায়তা প্রদান করেন। শিক্ষকের ভূমিকা লক্ষণীয় এটাই প্রকৃত সত্য। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসে যায়, শিশুর প্রথম পাঠশালা গৃহ হলে তার শিক্ষক কে? অর্থাৎ শিশু শিক্ষার ব্যাপারে গৃহ শিক্ষকের দায়িত্ব কে পালন করেন? ব্যতিক্রম স্বীকার করে বলা যায় যে, সাধারণত: শিশুর অভিভাবক অর্থাৎ মা-বাবাই গৃহ নামক পাঠশালায় তার শিক্ষকের ভুমিকা বা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। প্রাসঙ্গিক ভাবে প্রশ্ন হতে পারে, অভিভাবককে বাস্তব অবস্থা ও দেশের প্রচলিত আইন বিভাগের বিধি বিধান এর কারনে এক এক ব্যাপারে এক এক জন অভিভাবক হতে পারেন। দীর্ঘ বর্ণনায় না গিয়ে মাতা-পিতা এবং লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শিশুর অভিভাবক বলে আমরা ধরে নিতে পারি। আর শিশু তথা প্রাথমিক শিক্ষা শিশু শিক্ষা জীবনে ধ্রæব সত্যটি গুরুত্ব সহকারে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। শিশু শিক্ষার ব্যাপারে বা প্রসঙ্গে আমরা অভিভাবকগণ সঠিকভাবে ভূমিকা পালনে সক্ষম হতে পারবো। পরিনামে আমাদের শিশু সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে এমন প্রত্যাশা করতে পারবো।
শিশু শিক্ষায় শিক্ষকের চেয়ে অভিভাবকের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ ধারণা থাকা চাই। শিশুকে গৃহে অভিভাবক না পড়িয়ে গৃহ শিক্ষক নিয়োগ করে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হলেও অভিভাবকই তার শিশু শিক্ষার ব্যাপারে নিয়োজিত শিক্ষকের সহযোগী হতে হবে। প্রতিটি শিশু সন্তানের জন্য মা-বাবা সবচেয়ে বেশি আপনজন। তাই, মা-বাবা দু’জনকেই তার শিশু শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দায়িত্ব পালনে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখা অতীব প্রয়োজন। শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যেক মা-বাবার কয়েকটি করণীয় কাজ হচ্ছে: ১. শিশু সন্তানের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া ২. তাদের সাথে অবসরে সময় কাটানো ৩. কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া ৪. একগুঁয়েমি পড়ালেখায় বন্দী করে না রাখা ৫. সময়ের কাজ সময়ে করার প্রতি খেয়াল রাখা ৬। সত্যবাক্য ও নীতকথা শেখানো ৭. তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রæতি না দেয়া ৮. সব সময় সব ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছে মাফিক চলতে না দেয়া ৯. খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া ১০. সঠিক জিনিসটা শেখানোর পরিবর্তে মারধর না করা।
লক্ষ্য করা যায়, গ্রামাঞ্চলে অনেক অভিভাবক এখনো তাদের সন্তানকে পড়াতে গিয়ে সন্তানের পড়ালেখায় অমনোযোগিতা কিংবা সঠিকভাবে পড়া না শেখা বা বলতে না পারার কারণে কঠোর শাস্তি ও কর্কশ ভাষায় বকাবকি করায় অভ্যস্ত। মাতা-পিতার এ ধরনের আচরণ কি তার শিশু শিক্ষার জন্য সঠিক সমাধান? না, আদৌও না।
গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, শিশুরা নানা প্রকৃতির ও আচরণের। কোন শিশু স্বাভাবিকভাবে শান্তশিষ্ট এবং নম্রস্বভাবের, কোন শিশু বদমেজাজি বা একগুঁয়েমি, কোন শিশু বেশি মেধাবী, কোন শিশু অল্পে তুষ্ট, কোন শিশু স্বাভাবিকভাবেই ভালো আচরণের এবং কোন শিশুর মিথ্যা বলার প্রবণতা বেশি। বিদ্যালয়, খেলার মাঠ বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে একদল শিশুর সমাবেশ ঘটলে লক্ষ্য করা যাবে যে, সব শিশু এক প্রকৃতির বা এক স্বভাবের নয়। কোন শিশুটির সহজাত প্রবণতা কি তা একজন শিক্ষকের চেয়ে তার অভিভাবকই বেশি জানেন। শিক্ষা দানে নিয়োজিত শিক্ষকের শিক্ষার্থীর এইসব প্রবণতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয় নয় প্রয়োজনীয় বলা যায়। ধরা যেতে পারে, ফুলের বাগানে যেমন ভিন্ন ভিন্ন ফুল, ভিন্ন ভিন্ন রং এবং সুগন্ধ, ঠিক শিশু সমাবেশ অথবা শ্রেণিকক্ষে এক একটি শিশু এক এক ধরনের। অর্থাৎ বিভিন্ন শিশুর আচার-আচরণ এবং মন মানসিকতা বিভিন্ন। এই বাস্তব সত্যটি মনে রেখে শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে নিয়োজিত শিক্ষক এবং অভিভাবক নিজ নিজ কর্তব্য পালনে যতœবান হবেন, এটাই প্রয়োজন।
শিশু শিক্ষার বিষয়ে দৃষ্টি এবং স্তরবিন্যাস এমন হতে হবে, যাতে করে শিশুর সহজাত মেধার বিকাশ সাধনের সাথে সাথে শিশুর মধ্যে সুনাগরিকের বীজ বপন হয়ে যায়। শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাকে সঠিকভাবে গড়ে ওঠার জন্য প্রথম পর্যায়ে তা করতে হবে। অর্থাৎ একটা প্রবাদ আছে, কাদা মাটি শক্ত হাওয়ার আগে যেমন ইচ্ছে আকার দেওয়া যায়, শক্ত হওয়ার পর তেমনটি আর পারা যায় না।
শিশু শিক্ষা প্রসঙ্গে শিশুকে গাইড করা এবং নিয়ন্ত্রণ করার কথাটি জড়িত। এ ব্যাপারে সবসময় সব ক্ষেত্রে সব শিশুকে তার ইচ্ছা মাফিক চলতে দেয়া ঠিক হবে বলে অভিজ্ঞতার আলোকে তা সমর্থন করা যায় না। বাস্তবে বিভিন্ন শিশুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতি অনুসরণ বাঞ্ছনীয় হবে বলে আমার বিশ্বাস। লক্ষ্য হবে, শিশুর সহজাত প্রবৃত্তি বিবেচনায় রেখে তার মেধাবিকাশে এবং জ্ঞান চর্চা ও অনুশীলনে সহায়ক হতে পারে ; এমন শিক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে তাকে উৎসাহিত করা। এ কাজটি প্রসঙ্গে নিঃসন্দেহে বলা যায়, শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকের চেয়ে তার অভিভাবকের ভূমিকায় সবচে’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: সম্পাদক-মাসিক শিক্ষামুকুর ও গবেষক