
মো. দিদারুল আলম
২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে প্রায় ১৮ মাস দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এমতাবস্থায় শিশু-কিশোররা একরকম গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। এই ঘরবন্দি শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর করার স্বার্থে অনিচ্ছা সত্তে¡ও এ সময় অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার জন্য অভিভাবকগণ বাধ্য হন, তাদের সন্তানদের হাতে এনড্রয়েড মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবসহ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস তুলে দিতে। অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি কৌত‚হল থেকে শিশুরা নানা ধরনের গেমস খেলতে শুরু করে এবং এক সময় এটা নেশায় পরিণত হয়। আসক্ত শিশু-কিশোররা নাওয়া-খাওয়া ভুলে এক সময় মত্ত হয়ে পড়ে গেমসে। এসব ডিভাইসের নেশায় ভাসতে থাকা শিশুরা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে এমনকি শিক্ষায়তনেও দেখা মেলে এর নেতিবাচক প্রভাব। বর্তমান প্রায় প্রতি ঘরে শিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সব অভিভাবকই আছে দুশ্চিন্তায়। বর্তমানে শিশু-কিশোরদের এ মরণ নেশার আসক্তির কারণে কিশোর-কিশোরীরা লেখাপড়ার নাম করে দারুণভাবে ঝুঁকে পড়েছে মোবাইলের বিভিন্ন অ্যাপসভিত্তিক গেমস, পর্নোগ্রাফি ভিডিও, পাবজি, ফ্রি-ফায়ারের মতো মরণঘাতি গেমসের নেশাসহ ইউটিউব, লাইকি, ফেসবুক, টুইটারসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি।শিশুদের আগে গল্প বা ছড়া শুনিয়ে খাবার খাওয়ানো ও কান্না থামানো হতো। এই কাজগুলোই এখন মোবাইলে গান চালিয়ে কিংবা কার্টুন দেখিয়ে করা হয়। এভাবে আস্তে আস্তে শিশুরাও স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সর্বাধুনিক মডেলের মোবাইল ফোনও এখন কারও সাহায্য ছাড়াই চালাতে পারে শিশুরা। অতিপ্রয়োজনীয় এই স্মার্টফোনের অপব্যবহারে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন নানা জটিলতা।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যৌথ পরিবার কাঠামো ভেঙে একক পরিবার তৈরি হওয়ার কারণে আরো বেশি পরিমাণে ছেলেমেয়েরা এই মোবাইলের প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ছে। মোবাইল আসক্তির ভয়াবহ এ প্রবণতায় বিশেষ করে উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা বর্তমান পরিস্থিতিতে এক বিরাট সংকটকাল অতিক্রম করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনের সঙ্গে যোগাযোগ হারানোর এই ভয়জনিত অসুখের নাম দিয়েছেন ‘নোমোফোবিয়া’। যুক্তরাজ্যের গবেষকরা বলেছে, মোবাইল অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে চোখের জ্যোতি আনুপাতিক হারে কমে যাবে, এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের চক্ষুবিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে যাবে। কানে কম শুনবে, আর এ বিষয়টি নির্ভর করবে মোবাইল ব্যবহারকারীর ওপর। কারণ সে কানের কতটুকু কাছাকাছি এটি ব্যবহার করে, উচ্চ শব্দে গান শুনে কি না। এ ছাড়াও শারীরিক বিভিন্ন অসংগতি দেখা দেবে। যেমন, শরীরের অস্থিসন্ধিগুলোর ক্ষতি হতে পারে। কমে যেতে পারে শুক্রাণু। গবেষকরা জানান, মোবাইল ফোন থেকে হাই ফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নির্গত হয়। এই ক্ষতিকর তরঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কে ক্যানসারের যোগসূত্র থাকতে পারে। এ ছাড়া শরীরের অন্য কোষকলা এই ক্ষতিকর তরঙ্গের প্রভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে পুরুষের প্রজননতন্ত্রেরও।
বাংলাদেশে শিশুদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশের মারাত্মক স্মার্টফোন আসক্তি রয়েছে। অন্যদিকে মাত্র ১৪ শতাংশ শিশু অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে। আরও দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন মায়ের ৪ জনই সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তি সম্পর্কে অবগত নন।একসময় বই পড়া ছিল জ্ঞানার্জন এবং অবসর সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম। আজ বই পড়ার সেই স্থান নিয়েছে স্মার্টফোন। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি মুক্ত বোধের বিকাশ ঘটানোর পেছনে বই যে ভ‚মিকা পালন করত, আজ প্রায় তা স্মার্টফোনের দখলে। এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারমুক্ত বোধের বিকাশ সাধনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোবাইল স্ক্রিনে দেখা ইতিবাচক ভিডিওগুলোর চেয়ে নেতিবাচক ভিডিওগুলো মানুষের মনে বেশি প্রভাব ফেলছে। ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা এবং অপরাধ। বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নেতিবাচক ভিডিও দেখার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে নানা সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকাÐ ঘটছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় ঘটানোর পেছনে স্মার্টফোনের নেতিবাচক ব্যবহার নীরব ভ‚মিকা পালন করছে। এ ছাড়া আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় সময়কে নষ্ট করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে এই স্মার্টফোন। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার পেছনে যে সময় দেওয়ার কথা ছিল, তা এখন মোবাইল চালানোর পেছনে ব্যয় করছে। অনলাইন ভিডিও, টিকটক, লাইকি ও ভিডিও গেমসের প্রতি চরম আসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। শিশুরাও কম আসক্ত নয়, মোবাইল ফোন একমুহূর্ত হাতে না থাকলে খাবার পর্যন্ত খায় না তারা। ক্রমাগত মোবাইল ফোনের ব্যবহার মস্তিষ্ক বিকাশে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্তি এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসর্ডার) নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। এই রোগে আক্রান্ত শিশু নির্দিষ্ট কোনো কাজে পূর্ণ মনোযোগ প্রদান করতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর মতে বর্তমান বিশ্বে ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সি অন্তত ৮০ লাখ শিশু-কিশোর এডিএইচডি-তে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা খিটখিটে স্বভাবের হয়ে থাকে, বানিয়ে বানিয়ে অযাচিত কথা বলার পাশাপাশি তারা সবার সঙ্গে অহেতুক তর্কে লিপ্ত হয়। তাছাড়া মস্তিষ্কের যে অংশে (রিওয়ার্ড সেন্টার) মাদকদ্রব্য তথা হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবার প্রতি আসক্তি জন্ম নেয় ঠিক সেই অংশেই কিন্তু ইন্টারনেট বা ভিডিও গেমসের প্রতি আসক্তি জন্মা
শিশু-কিশোররা প্রায় সময় মোবাইলে বিভিন্ন ভিডিও দেখতে থাকলেতারা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে, অনেকেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেদের সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলবে। ঘরকুনো স্বভাবের হয়ে যাবে। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো কিভাবে অটুট রাখতে হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো শিখে উঠতে পারবে না। ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের দূরত্বের সৃষ্টি হবে। তাই অভিভাবকদের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি, আপনার সন্তানের হাতে ফোন না তুলে দিয়ে তাকে সময় দিন। মোবাইল গেম বাদ দিয়ে নিজেরা তাদের সঙ্গে খেলুন। সন্তানকে মোবাইল, ট্যাব এবং টিভির ভার্চুয়াল বিনোদন না দিয়ে ন্যাচারাল কোথাও ঘুরতে নিয়ে যান। তাদেরকে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করুন। মোবাইল আসক্তি থেকে বাঁচতে স্মার্টফোন ব্যবহারের নিয়ম নির্ধারণ করা, ডিজিটাল ডিটক্স চালু করা, অ্যালার্ম ঘড়ি ব্যবহার করা, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, এবং মিস করার ভয় নিয়ন্ত্রণ করার মতো কৌশলগুলো অবলম্বন করতে পারেন। এছাড়াও, নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ ব্যবহার করে ফোনের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করা এবং নতুন শখের প্রতি মনোযোগ দিয়ে ফোনের ব্যবহার কমানো সম্ভব। যেহেতু বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই অভিভাবকরা ইউটিউবে শিক্ষার্থীদের উপযোগী ভিডিও এবং ইংরেজি শেখার বিভিন্ন ভিডিও দেখলে শিক্ষার্থীরাও এগুলোতে অভ্যস্ত হবে।
লেখক : শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যলেখক











