শিশুর বেড়ে ওঠা : মা বাবার করণীয়

2

এম এ ফয়েজ

মাতৃগর্ভ হতে এক একটি মানব শিশুর জন্ম। এসব শিশু হচ্ছে জীবন্ত ক্রমবর্ধমান জীব। অন্যান্য জীবের তুলনায় শিশুরা বেশ অসহায় এবং পরনির্ভরশীল। মানব শিশুর এ পরনির্ভরশীলতার কারণেই শিশুর মাকে তার প্রয়োজন এবং যতœ সম্পর্কে সচেতন হতে হয়। পরিবারে শিশুর যথাযথ যতœ নেওয়ার ফলেই আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে। কিন্তু জন্মের পর পরই মানব শিশু থাকে অসহায়। এ অসহায় শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং শিশুটির পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য যতেœর একান্তই প্রয়োজন। শিশুরা জন্ম নেয় অনেক সুপ্ত প্রতিভা ও সম্ভাবনা নিয়ে। আর এসব সম্ভাবনা বাস্তব রূপ লাভ করে উপযুক্ত যতœ ও পরিচর্যার মাধ্যমে। প্রতিটি মা-বাবাই চায় তাদের শিশু সন্তানকে আগলে রাখতে এবং তারা সব সময় চিন্তিত থাকেন তাদের সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে। পিতা-মাতা চান তার শিশুটি যেন সুস্বাস্থ্যবান ও বলবান হয়ে ওঠে। কেননা, শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রাথমিক দায়িত্ব পালনে মা-বাবা ব্যর্থ হলে শিশুর সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ঘটবে না। ফলে শিশুটি জাতির ভবিষ্যৎ এ কথাটি হবে একেবারে অর্থহীন। সুতরাং জাতিকে শক্তিশালী করতে, উন্নত সমাজ গড়তে এবং দায়িত্ববান প্রজন্ম সৃষ্টি করতে হলে আমাদের সকলের কর্তব্য আজকের নবজাত ও সম্ভাবনাময় শিশুটির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য যথাযথ যতœবান হওয়া। সুখাদ্য ও সঠিক পুষ্টিই পারে শিশুর জীবন সুন্দরময় করে তুলতে। তাই, শিশুর সুস্বাস্থ্য গঠনের নিমিত্তে মা-বাবাকেই পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বলা বাহুল্য যে, আমাদের দেশে বেশিরভাগ জনগণই অশিক্ষিত। ফলে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তারা জানে না কিভাবে শিশুটির পরিচর্যা করতে হবে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মা যদি অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টিতে তার শিশু সন্তানের পরিচর্যা করতে পারেন তাহলেই শিশু সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান শিশু পাওয়ার জন্য এবং শিশু সঠিকভাবেই গড়ে ওঠার জন্য প্রাথমিক আবশ্যিক প্রয়োজন হচ্ছে খাদ্যের। সাধারণত ঃ শিশু দুই তিন মাস বয়স পর্যন্ত শুধু তরল খাবারই খেয়ে থাকে। উল্লেখ্য, জন্ম থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ ও তরল সহজ প্রাচ্য খাবার এবং তা শিশুর বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পুষ্টিকর অত্যাবশ্যকীয় খাবার। একজন শিশুর দেহ গড়ে ওঠার জন্য সব ধরনের মৌল পদার্থ মাতৃদুগ্ধে পাওয়া যায়। এজন্য শিশুর জন্য মায়ের দুধের কোন বিকল্প নেই। মায়ের দুধে উপস্থিত লৌহ নামক খনিজ উপাদান সহজে শোষিত হয় এবং শরীরের রক্ত গঠনে কাজে লাগে। ফলে লৌহের অভাবজনিত কুফল থেকে বেশি রক্ষা পায়। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হলো-শিশু জন্মের পরপরই নবজাতকের প্রথম খাবার মায়ের বুকের নিঃসৃত প্রথম ঘন আঠালোযুক্ত শালদুধ খাওয়ানো জরুরি। অন্ততঃ শিশুর দু বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করতে হবে। যা তাদের সুস্থ জীবনের বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করবে এবং শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। অনেক মা – শিশুর জন্মের পর তার শিশুকে শাল দুধ পান করাতে চান না। তাদের এহেন ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভুল। শিশুর জন্মের পরপরই মায়ের বুকে যে দুধ উৎপন্ন হয় তাকে কলষ্ট্রাম বা শালদুধ বলা হয়ে থাকে। এ শালদুধ দেখতে আঠালো ও হলুদ বর্ণের হয়। শালদুধ শিশুর শরীরে যত বেশি পুষ্টি যোগায় এবং রোগ প্রতিরোধ শক্তি যোগায় অন্য কোন খাবারে তা থাকে না। তাই শিশুর জন্য কলষ্ট্রাম বা শালদুধ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই জন্মের পরপরই মায়ের দুধ শিশু সন্তানকে খাওয়ালে শিশু অনেক ছোটখাটো অসুখের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে এবং অনেক খারাপ উপসর্গ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
শিশুর বয়স ৬ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সময় থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে অন্যান্য খাবার খাওয়ানো শুরু করতে হবে। এসময় তাদের ডিম, মাছ, আলু ভর্তা করে খাওয়ালে শরীর বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উপাদান পাবে। প্রতি মাসে শিশুর ওজন নিতে হবে, যদি কখনো মনে হয় শিশুর নিয়মিত ওজন বাড়ছে না, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিশুর বয়সের প্রথম বছরই শিশুকে দুরারোগ্য অসুখের সব ক’টি টিকা অবশ্যই দিয়ে দিতে হবে।
এরপর শিশুর বয়স ৯ মাস পূর্ণ হলে দিতে হবে হামের টিকা। শিশুকে ঘন ঘন দৈনিক কয়েকবার খাবার দিতে হয়। কারণ শিশু একসঙ্গে বেশি খেতে পারে না। শিশুকে পরিমাণ মতো ঘন ঘন খাওয়ালে পেটের পীড়া থেকে মুক্ত থাকবে। পাশাপাশি ঘন ঘন শক্তিদায়ক খাবার খাওয়ালে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি সঠিক সময়ে হবে। তৈরি খাবারের ফাঁকে ফাঁকে শিশুকে কলা, আপেল, কমলা, বিস্কিট ইত্যাদি খাবার পরিমাণ মতো খাওয়ানো যেতে পারে। তাতে শিশুর বয়স বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করতে পারবে। শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত খাবার দিতে হবে। মা- বাবার অজ্ঞতার কারণে অনেক শিশু ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার থেকে বঞ্চিত হয়। যার ফল শিশুর জন্য হয় অতি ভয়াবহ। এক সমীক্ষায় জানা যায় ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে বাংলাদেশে প্রতিদিন ৩০ হাজার শিশু অন্ধত্ব বরণ করছে। আর মাতৃদুগ্ধ পান করার কারণে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে এমন শাক-সবজি ও হলুদ ফলমূল বাজারে আসে, যাতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’। বাবা-মা একটু সজাগ হলে বাজার থেকে গাঢ় সবুজ শাকসবজি হলুদ ফল যেমন – আম কাঁঠাল, পেঁপে বিভিন্ন প্রকার ফলমূল সংগ্রহ করে শিশুদের খাইয়ে পূরণ করতে পারেন ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব। এরপরও প্রয়োজনে ভিটামিন এ ক্যাপসুল সংগ্রহ করে শিশুদের খাওয়ানো যেতে পারে। শিশু সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় পাতলা পায়খানায়। সাধারণত : শিশুর পাতলা পায়খানা হয় গরুর দুধ ও গুড়া দুধ খাওয়ালে। মায়ের দুধ না খাইয়ে নিয়মিত গরুর দুধ ও গুঁড়া দুধ খাওয়ালে শিশুর পাতলা পায়খানা হয়ে ওজন কমে যেতে পারে। শিশুর পাতলা পায়খানা হলে ক্ষুধা কমে যায়। যা খাওয়ানো হয় তা শরীরের কোন কাজে লাগে না। পাতলা পায়খানা হলে শিশুকে খাবার স্যালাইন দিতে হবে। শীতের দিনে শিশুকে গরম জামা-কাপড় এবং পায়ে মোজা ও জুতো পরিয়ে দিতে হবে। যাতে শিশুর কষ্ট না হয়। এখন চলছে শীতকাল। শীতের ঠান্ডা থেকে পরিত্রাণের জন্য এ সময় শিশু পালনে মা- বাবাদের অতি সাবধানতার সাথে যতœশীল হওয়া জরুরি। শিশুর গায়ে বেবি লোশন মালিশ করে সকালের মৃদু রোদে কিছু সময় শিশু সন্তানকে শুয়ে রাখা উপকারী। যেহেতু সুর্যের আলো থেকে ভিটামিন ‘ডি’ শিশুর শরীরের হাড় শক্ত ও মজবুত করে। শিশুকে প্রতিদিন গোসল দিলে পরিচ্ছন্ন থাকবে। তবে এক্ষেত্রে মায়েদের সতর্ক খাকা দরকার। শিশুকে হালকা কুসুম গরম জলে গোসলের ব্যবস্থা, নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করানো, হাত ও পায়ের নখ বড় হলে কেটে দেওয়া এবং শিশুকে পরিষ্কার পোশাক পরিয়ে রাখা প্রয়োজন। কোন অবস্থায় ময়লা জামা-কাপড় পরানো উচিত নয়। কেনন্য এতে শিশুর ত্বকে চুলকানি হতে পারে। শিশুর সুস্থতার জন্য পরিবারের সবাই পরিচ্ছন্ন থাকছে কিনা, খাবার ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকছে কিনা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। শুধুমাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার প্রয়োজনীয়তা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমাদের দেশের প্রত্যেক মাতা-পিতার শিক্ষিত হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ শিক্ষিত, মা-বাবার কাছ থেকে জাতি পেতে পারে আগামী দিনের উপযুক্ত নাগরিক। আসুন শিশুর সুন্দর সুস্বাস্থ্য গঠন ও বেড়ে ওঠার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং সকলে নিজ নিজ সন্তানের প্রতি অধিকতর যতœবান ও আন্তরিক হই।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক শিক্ষামুকুর, গবেষক ও কলামিস্ট