শিশুর পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা

7

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

শিশুরা সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্র নাগরিক হলেও শিশুকাল একজন মানুষের ভবিষ্যত জীবন গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দর পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ এবং সুশিক্ষা নিশ্চিত করে শিশুকে দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এই সময়টা থেকেই।
আমার মেয়ে নির্ঝরা-নাজিবাহ সেদিন বলছিল, আব্বু রাস্তায় কতগুলো লোক ঝগড়া করছিল এবং পচা পচা কথা বলছিল। আড়াই বছরের আমার ছোট সন্তান আবদুল্লাহ নাবহান তেমন কিছু বুঝেনা যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেও কিছু কিছু খেয়াল করার চেষ্টা করে। কীভাবে যে মেয়ে দুটোকে বলি লোকগুলোর নৈতিক শিক্ষার বড়ই অভাব বা তারা হয়তো বুঝছেনা এসব খারাপ ভাষা ব্যবহারের কুফল। সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টাও হয়তো ভেস্তে যাবে কোন এক সময়। নিজেদের সন্তান নিয়ে শংকায় থাকি কখন কী হয়! ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষাটা তার পরিবার থেকেই আসতে হবে প্রথমে। সেজন্য প্রত্যেক বাবা-মা, অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। জন্মের পরপরই শিশুর স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তার সুশিক্ষা নিশ্চিতের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। কারণ, সন্তানকে সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। আজকাল ছেলেমেয়েরা একটু বেশি স্বাধীনতা চায়, আর তারা একটু বেশি সংবেদনশীল। এই ফেসবুক-ইউটিউবের যুগে নিজেদের সন্তানদের নিয়ে প্রত্যেক বাবা-মা ই উদ্বিগ্ন। তাই খুব সহজেই ঘটে যায় নানা বিপত্তি। এ কথা বলা হয়ে থাকে যে, একটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হচ্ছে তার পরিবার। বড় হয়ে সে যে পরিবেশেই শিক্ষা নিতে যায়না কেন পারিবারিক শিক্ষার একটা প্রভাব তার মধ্যে সবসময় পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রত্যেক মা বাবারই সন্তান প্রতিপালনে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।
যেহেতু পরিবার ও সমাজের প্রভাব শিশুর উপর পড়ে সেহেতু প্রত্যেককে আচার, ব্যবহার, কথা-বার্তা বলার সময় শিশুর প্রতি কী প্রভাব পড়তে পারে তা ভাবা উচিত। শিশুকে ছোটবেলা থেকেই আদব-কায়দা শেখানো জরুরি। বড়দের সম্মান আর ছোটদের আদর করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর এ শিক্ষাটা তার পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। পরিবারের বড়দের কথা মেনে চলা, ছোট ভাই বোনদের সঙ্গে জিনিসপত্র শেয়ার করা ইত্যাদির ব্যাপারে শিশুকে মনস্তাত্তি¡কভাবে গড়ে তুলতে পারলে পরবর্তিতে তা কাজে লাগাতে পারবে সে।
সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই উৎসাহ দিতে হবে নিয়ম-শৃংখলা মেনে চলতে। কারণ শৃংখলা মানে হচ্ছে জীবনকে গুছিয়ে চলা, যা জীবনকে আরও সুন্দর ও পরিপাটি করে তুলবে। সামাজিক অনেক খারাপ পরিবেশ শিশুর উপর প্রভাব ফেলে। এসব থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে। ভালো বিষয়গুলো তুলে ধরার পাশাপাশি শিশুকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিশুর মাঝে সামাজিক গুণাবলি, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, সহানুভূতি, মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, অসহায় ও গরীব-দুঃখীদের প্রতি সমব্যথী হওয়াসহ সব গুণের যাতে সমাবেশ ঘটে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে আমাকে আপনাকে সবাইকে। বর্তমান দুনিয়ায় এমন গুণসম্পন্ন মানুষের বড়ই অভাব। সততা ও ন্যায়ের প্রতি শিশুকে আগ্রহী করে তুলতে পারলে বড় হয়ে সে নিজেকে একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিশুকে নৈতিকতা ও সততার শিক্ষা দিতে হবে। আমরা অনেকে এ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেইনা। সচেতন থাকিনা এ বিষয়ে। ক্ষেত্রবিশেষে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাকে পুরোপুরি এড়িয়েই চলি। মনে করি এই শিক্ষা সন্তানকে কনজারভেটিভ করে তুলবে। অথচ সুশিক্ষার জন্য নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। শিশুর সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে এর কোন বিকল্প নেই। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সাথে ভালো এবং শিক্ষামূলক বইও শিশুকে পড়ার জন্য অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। শিশুকে কখনোই অন্যায় করতে উৎসাহ দেওয়া উচিত নয়। কারণ অন্যায়ের পরিণতি সব সময় খারাপ হয়। সন্তানকে স্বাবলম্বী ও যথাযথ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ছোটবেলা থেকেই এ বিষয়ে তাকে সচেতন করে তুলতে হবে।
সমাজের বর্তমান পরিবেশটা দেখলে বড় ভয় লাগে নিজেদের সন্তানদের কীভাবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলব এই ভেবে। তাদের শিক্ষা, নিরাপত্তা নিয়ে সদা উৎকণ্ঠিত থাকি। এরপরও জীবনে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয় অভিভাবকদের। বর্তমান এই আধুনিক যুগে শিশুকাল থেকেই শিশুর সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে চেষ্টা না করলে সব আশা-স্বপ্ন ভেংগে চুরমার হবে। যে আশা নিয়ে সন্তানকে মানুষ করা হয় তা নিমেষেই অতল গহব্বরে হারিয়ে যেতে পারে। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত। নতুন এবং নিরাপদ একটি পৃথিবী তাকে দিতে হবে। এজন্য শিশুর সুশিক্ষার ব্যাপারে আমাকে,আপনাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। স্কুলের পাঠের ব্যাপারে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে তেমনিভাবে তার নৈতিক চরিত্র যেন সুন্দর হয় সে ব্যাপারে আমাদের সকলের সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করি। বিশ্বের সকল শিশুর সুশিক্ষা নিশ্চিত হোক। আমাদের আগামী প্রজন্ম হোক আদর্শবান ও নৈতিকতার বলে বলিয়ান।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট