আজ সভ্যতার চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখী বিশ্ব। আর ইসরায়েল এর জন্য প্রধানত দায়ী। সেই সাথে ইসরায়েলকে যারা সহযোগিতা করছে, সমর্থন দিচ্ছে- তারা দায় এড়াতে পারবে না। গতকাল দৈনিক পূর্বদেশসহ দেশের সবকটি সংবাদপত্রের শিরোনাম ইসরায়েল গাজায় মারাত্মক সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে যাচ্ছে, আর তাতে গাজার অন্য সকল বয়সী মানুষের কথা বাদ দিলে শুধু শিশু মারা যাবে ১৪ হাজার। একটি আগ্রাসী দেশ কত জঘন্য ও বর্বর হলে এমনটি পদক্ষেপের কথা ভাবতে পারে! বিগত ছয়মাসে ইসরায়েলের আগ্রাসন ও একপেশে যুদ্ধে ৫৩ হাজার ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেছে, যার তিন ভাগের দুই ভাগ ছিল শিশু ও নারী। গত মার্চ মাসে গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিশুদের স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছিল, কারণ যুদ্ধে এতোবেশি শিশু মারা গিয়েছেন গাজায় আর কোন শিশু অবশিষ্ট ছিলনা, যাদের স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে গাজায় জাতিগত গণগত্যার কারণে যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসী তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছিল, বিশ্বব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছিল তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে ইসরায়েল কিছুটা নমনীয় হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক ভ‚মিকা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসরায়েল বরং আরো হিংস্র হয়ে গাজাকে জনমানবশূন্য করার অমানবিক পরিকল্পনা নিয়েছে। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে যদি গাজায় ইসরায়েল মারাত্মক অভিযান করে তবে এ শহরটিতে আর কোন শিশু অবশিষ্ট থাকবেনা। এ খবরে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া ও উত্তর কুরিয়া ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা ইসরায়েলের প্রতি কঠোর হুশিয়ার করে বলেন, অবিলম্বে গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করে মানবিক সাহায্য প্রবেশ করতে দেয়ার আহবান জানিয়েছেন। অপরদিকে জাতিসংঘ ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ফিলিস্তিনে নিরীহ মানুষের ওপর ইসরায়েলের বর্বরতায় প্রতি মুহূর্তে তা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, দৃশ্যমান এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ বিশ্বের ক্ষমতাধরদের তরফ থেকে নিতে দেখিনাই। এ প্রথম যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি প্রভাশালী দেশ ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে।
সূত্র জানায়, গত রবিবারও গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নারী-শিশুসহ আরও অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ভোর থেকে চালানো এ হামলায় হতাহতের সংখ্যা যে আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলের হামলায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৮৭ জন।
ইউনিসেফ সতর্ক করে জানিয়েছে, গত ১৮ মার্চ থেকে ফের হামলা শুরু করার পর থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ শিশু নিহত হচ্ছে। ফিলিস্তিন ও গাজার ১০ লাখেরও বেশি শিশু এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পাচ্ছে না জীবন রক্ষাকারী সহায়তা। ইসরায়েলের কারণে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি জনতার যেসব মৌলিক অধিকার-তাও লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের উপচেপড়া ভিড়; কিন্তু চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের সুযোগই নেই। কারণ চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি তো আছেই, চিকিৎসাকর্মীদেরও টার্গেট করে হত্যা করার কারণে রয়েছে চিকিৎসকের ঘাটতি। ২৩ মার্চ ১৫ জন জরুরি চিকিৎসাকর্মীকে হত্যার যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, তা খন্ডিত চিত্র মাত্র, ইসরায়েলের এমন পৈশাচিকতার নজির রয়েছে অসংখ্য।
ক্ষমতার মোহে নিমজ্জিত বিশ্বনেতারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও সাধারণ মানুষ এই বর্বরতার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। আমেরিকাসহ বিশ্বনেতারা নিশ্চুপ রইলেও মনুষ্যত্ব এখনো যাদের হারিয়ে যায়নি, সেই আমজনতা এই অনাচারের সীমা টানতে পথে পথে বিক্ষোভে নেমেছেন। ফিলিস্তিনি ন্যাশনাল অ্যান্ড ইসলামিক ফোর্সেস নামে একটি গ্রুপ গাজায় চলমান ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানির প্রতিবাদে বৈশ্বিক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। একই কর্মসূচি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি সংগঠন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের প্রতিবাদ এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও ক্লাস-পরীক্ষা বয়কটের কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েল যুদ্ধের নামে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যে বর্বরতা চালাচ্ছে, এমন নৃশংসতা আগে কখনো দেখা যায়নি। হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের ওপর নেতানিয়াহু বাহিনীর এ হামলা খোদ ইসরায়েলিরাও ভালো চোখে দেখছে না। যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে গাজায় বোমা হামলার প্রতিবাদে এরই মধ্যে ফুঁসে উঠেছে ইসরায়েলের মানুষ। মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন গাজায় হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। প্রায় হাতছাড়া হওয়া ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে গিয়ে যে মরণ খেলায় মেতেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, তা এ অঞ্চলের ভাগ্যকে কোথায় নিয়ে ফেলবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ঘৃণ্য জাতি হিসাবে গণ্য হওয়ার মতো সব অপরাধই যে ইসরায়েল করেছে, ইতিহাসের পাতায় তা লেখা থাকবে। ক্ষমতার মোহ নয়, মানবতার স্বার্থে বিশ্ব সম্প্রদায়কে ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গাজার অবুঝ শিশুদের রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে। এ পৃথিবী আগামীর ভবিষ্যত শিশুদের জন্য। তাদের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার দায় বিশ্বসম্প্রদায়ের। গাজার শিশুদের ইসরায়েল হত্যা করবে আর বিশ্ববাসী দেখে থাকবে তা হতে দেয়া যায় না। এ শিশুরা আমাদের ক্ষমা করবেনা। তাদের বাঁচাতে হবে, বাঁচাতে হবে ফিলিস্তিনকে তাদের স্বাধীনতার স্বাদ ও অধিকার দিয়ে।