আসাদুজ্জামান রিপন
শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে ধুঁকছে হালদা। শাখা-প্রশাখা বেয়ে আসা বিষাক্ত বর্জ্যে দিনদিন হারাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। প্রতিদিন মৃত মাছ ভেসে উঠছে। বর্জ্যরে চাপে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, শামুক, জলজ উদ্ভিদ। দেশের একমাত্র মিঠাপানির প্রাকৃতিক কার্প মাছের প্রজনন ক্ষেত্র আজ যেন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না হালদা তরল বর্জ্যরে ¯্রােত। গবেষকরা বলছেন, হালদা রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। দূষণ বন্ধে সরকার বা কোন সংস্থা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানাগার (ইটিপি) স্থাপন করে। তাহলে কারখানার দূষণ থেকে হালদা নদীকে রক্ষা করা সম্ভব।
নগরীর বাহির সিগন্যাল এলাকায় বিভিন্ন শিল্প কারখানা, জুতা ও প্যাকেজিং কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানকার বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে। যেখানে গিয়ে এসব বর্জ্য পানিতে মিশেছে। এসব বর্জ্য কুইয়াশ খাল ও বাথুয়া খাল হয়ে সরাসরি হালদা দিয়ে মিশছে। এসব শিল্প কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্যে আর সুয়ারেজ বর্জ্যে দিন দিন হালদার পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে।
শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত তরল বর্জ্যকে ‘পিএইচ’, ‘বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড’, ‘কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড’, ‘টোটাল ডিসোল্ড সলিডস’, ‘টোটাল সাসপেন্ড সলিডস’ পাঁচটি প্যারামিটারে ভাগ করা হয়। কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যে এসব প্যারামিটারে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেলে জীববৈচিত্রের জন্য বিপদজনক ধরা হয়।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ অনুসারে, কারখানা থেকে নির্গত তরল বর্জ্যে প্রতিলিটারে পিএইচ ৭-৯ মিলিগ্রাম, বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড ৩০ মিলিগ্রাম, কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড ২শ, টোটাল ডিসোল্ড সলিডস ২ হাজার ১শ ও টোটাল সাসপেন্ড সলিডস ১শ এর কম থাকতে হবে।
ওয়েল কম্পোজিট নিট লিমিটেডের ইটিপি থেকে নির্গত তরল বর্জ্যে পরীক্ষা করে গবেষকরা সেখানকার বর্জ্য নিদিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি দূষিত। নির্গত তরল বর্জ্যে প্রতিলিটারে পিএইচ ৭ দশমিক ৯৮ মিলিগ্রাম, বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড, ৩৮ মিলিগ্রাম, কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড ২৯১ মিলিগ্রাম, টোটাল ডিসোল্ড সলিডস ৩ হাজার ৪৩০ মিলিগ্রাম ও টোটাল সাসপেন্ড সলিডস ১২৫ মিলিগ্রাম উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নির্গত তরল বর্জ্যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়ার কারণে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিরেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবেশ আইন অনুযায়ী তরল বর্জ্য সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে তরল বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি স্থাপন এবং কার্যকরভাবে তা পরিচালন করা বাধ্যতামূলক। ইটিপি না থাকলে উৎপাদনকাজ চালানোর অনুমতি নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানে ইপিটি স্থাপন করা হয়েছে এসব ইটিপি নিয়মিত পরির্দশন করা হয়। এর মধ্যে ইটিপি বন্ধ রাখা বা সঠিকভাবে বর্জ্য পরিশোধন না করলে জরিমানার আওতায় আনা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রতিষ্ঠাতা ও হালদা নদী গবেষক অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া পূর্বদেশকে বলেন, হালদা দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি মাছের প্রজনন কেন্দ্র ডলফিনের আবাসস্থল। শিল্প কারখানা আর সুয়ারেজের বিষাক্ত তরল বর্জ্যে নদীটি মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে।
হালদার শাখা খালের সাথে বাহির সিগন্যাল এলাকার শিল্পকারখানা সংযুক্ত। এসবের বিষাক্ত বর্জ্যে শাখা খালের মাধ্যেমে হালদায় মিশছে। এর বর্জ্যেগুলো আবার পথ পরিবর্তন করে কর্ণফুলিতে নেওয়া যাবে না। যদিও কর্ণফুলি জোয়ার-ভাটার নদী। জোয়ারে বিষাক্ত বর্জ্য হালদায় চলে আসে। কর্ণফুলি দূষিত হলে হালদাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার, কারখানাগুলো বন্ধ করা যাবে না। এর উপর অনেক মানুষ নির্ভরশীল। লাখ লাখ কর্মসংস্থান জড়িত। তিনি আরো বলেন, সরকার বা কোন সংস্থা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানাগার (ইটিপি) স্থাপন করে তাহলে কারখানার দূষণ থেকে হালদা নদীকে রক্ষা করা সম্ভব। কয়েকটা ক্লাস্টারে ভাগ করে সব কারখানার সাথে সংযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। সব কারখানার বর্জ্য নিদিষ্ট জায়গায় চলে আসবে এবং সেখানে পরিশোধন হয়ে বাহিরে চলে যাবে। এর ফলে একদিকে কারখানাগুলোর ঝামেলা থাকবে না একইসাথে হালদাও রক্ষা পাবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক সোনিয়া সোলতানা বলেন, কালুরঘাটের বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য কুয়াইশ খালসহ বিভিন্ন খাল হয়ে হালদা নদীতে পতিত হয়। হালদার মত অতি গুরুত্বপূর্ণ নদীকে রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত বর্জ্য হালদা নদীতে ফেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্টানকে জরিমানা আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।