মিঞা জামশেদ উদ্দীন
বছরের শুরুতে মেয়ের নানা দাবি, এটা দাও-ওটা দাও। আমাদের একটি মাত্র মেয়ে। সে যেটা চায় সেটি দিতে চেষ্টা করি। অবশ্য নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যে। তবে তারও আহামরি দাবিদাওয়া তেমন একটা থাকে না। তাছাড়া বলা আছে, স্কুল সংক্রান্ত ও লেখাপড়া ব্যতিত অন্য বিষয়ে যেন নয়, তাহলে সেগুলো অগ্রাধিকার পাবে। না। মেয়ে আমাদের লক্ষী-মামণি। এর বাহিরে অতিরিক্ত কিছু চায় না। সে এখন অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রথমে সে বলল, স্কুল ড্রেস্ট কিনে দিতে হবে। অবশ্যই এটি যুক্তিসঙ্গত দাবি। বছরের প্রথম ড্রেসতো লাগবেই। অবশ্য পরে বলল, না, এখন শুধু স্কুল ড্রেসের সোয়েটার কিনে দিলে চলবে; আমিও হাফ ছেড়ে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে-এ যাত্রায় রক্ষা পাই। এরমধ্যে বিশেষ কাজে ঢাকায় আসা হয়। সঙ্গে মনে করলাম, মেয়ের জন্য যেতে সোয়েটার কিনে গেলে ভালো হয়। তাই ঢাকার শাহবাগের কয়েকটি মার্কেটে খোঁজ দেওয়া। না, ওই কালারের স্যুয়েটার ঐসব মার্কেটে বিক্রয় করা হয় না। দু”- একজন দোকানদার বললেন, স্কুলের স্যুয়েটার পাবেন বঙ্গ বাজার ও নিউ মার্কেটে। অবশ্য হাতে মেলা সময় ছিলো না। রাতের মধ্যে চট্টগ্রাম পৌঁছতে হবে। তাহলে কি করা যায়- সিদ্ধান্ত নিই চট্টগ্রাম থেকে কেনার। এর চাইতে বেশি ভালো হয়, তাদের স্কুলের আশেপাশের মার্কেটগুলোতে পাওয়া যায় কিনা খোঁজ করে দেখলেইতো হয়। পরে তাকে মোবাইল করে তা জানালাম। সেও বলল, তাকে ৪শ’ টাকা দিতে। আমি দিলাম ৩শ’ টাকা। বাকী টাকা ও-র মা থেকে নিতে বললাম। অবশ্য ৪শ’ টাকা নয়, ৫শ’ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। যাক, এ দাবি কোনোভাবেই পূরণ করা হল। এবার তার দাবি একটি ফুটবল ও স্কুলজুতো। অবশ্য দ্বিতীয় দাবি না হলেও তৃতীয় দাবি স্কুল রিলেটেড। এর জন্যও নগদ টাকা দেওয়া হয়। বললাম, তোমার মাকে নিয়ে ভাটিয়ারীর থেকে কিনে নিও। তার দাবি ৬০০ টাকা। দেওয়া হয় ৫০০টাকা। এরমধ্যে একটি গাইডে কিনতে গিয়ে যা-না ঝামেলায় পড়তে হয়। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার বই মার্কেটের বেশ কয়েকটি দোকানে খোঁজা হয়। গণিত অলিম্পিয়াড গাইডের এ বইটি সুনির্দিষ্ট দোকানে বিক্রি করা হয়। তবে যে মূল্য লেখা আছে গায়ে তা দিয়েই কিনতে হয়; তবে গাইড বইটি নিউজ প্রিন্টের। পৃষ্ঠা ও কাগজ অনুয়ায়ী এর মূল্য তুলনামূলক অনেক বেশী। মাত্র ২৫ শতাংশ কমিশন দেয়ার পরও তা মনে হল। কমকরে এ গাইডে ৮০ শতাংশ কমিশন দেওয়া উচিত, তাতেও ক্রেতারা শতভাগ ঠকবে। অর্থাৎ গায়ের মূল্য ছিল অত্যধিক বেশি। অবশ্য নিজেরও ২-১টা বই প্রকাশিত হয়েছে। এ গাইডটি লেখক একজন, প্রকাশনা সংস্থাও সুনির্দিষ্ট একটি। পুরোটা একচেটিয়া ব্যবসা করে বসে। অনেকটা হাতিয়ে নেয়ার কাজকারবার হয়। যখন একটি গ্রন্থ বা বই প্রকাশসংখ্যা বেশি হয়, তাহলে তার প্রিন্টিং খরচও কমে আসে। আমাকে বইটি হাতে নিয়ে বহুবার ভাবতে হয়। এসব ক্ষেত্রে তদারকি কি একটু কম মনে হল; অবশ্য জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র বা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পক্ষে তা খতিয়ে দেখে চাড়দেয়া বা না দেয়ার বিধিমালা থাকা উচিত। ইচ্ছেমাফিক মূল্য বসিয়ে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার একধরনের প্রবণতা পুরো জাতীর মধ্যেও চেপে ধরেছে। অবশ্যই ধরনের মানস ও প্রবণতা থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজা উচিত নয় কী?
এবার তৃতীয় বা দ্বিতীয় দাবি ফুটবল। প্রথম থেকে এ দাবি পূরণে অনীহা কাজ করে। তার কারণ একা-একা তো ফুটবল খেলা যায় না; এটি টিম বা গ্রুপের খেলা। ৫-৭-৯-১১ জনের খেলা। প্র্যাকটিসও গা-গা করা যায় না। স্কুল থেকেও খেলা হচ্ছে না। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলেছি, তাঁদের তেমন একটা আগ্রহ নেই। তারপরও মেয়ে যখন চেয়েছে, পাঁচটি নয়, দশটি নয়, তা আবার একটি মাত্র বল! অবশ্য একটা কিনে দেব, না হয় আক্ষেপ থেকেই যাবে। বলে, সে একা-একা হলেও প্র্যাকটিস-কসরত করবে। তার এ উৎসহ বা প্রেরণা আসে সম্ভবত নারী দলের ঈর্ষণীয় বিজয়ে। রীতিমতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রেকর্ড করে এ বিজয়। জাতীয় সম্মানও বাড়ে। অথচ এ অর্জনকে উপেক্ষা বা অবহেলা করা হচ্ছে। এটি জাতীর জাগরণ বলা যেতে পারে। শুধু মাধ্যমিক পর্যায়ে নয় প্রাথমিক স্কুল পর্যায়েও চালু করতে হবে নারী ফুটবল খেলা। যাতে করে শিশু থেকে তাদের শারীরিক গঠন, মনন ও শক্তিমত্তা এবং পারদর্শী হয়ে উঠবে ক্রিড়া নৈপূন্যতায়ও। প্রয়োজনে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এতে করে শিশুদের সুকুমারবৃদ্ধিসহ মের্ধার বিকাশ গড়বে। আর এ জন্য ক্রিড়া শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এটি চেতনারও বিষয়- নারী খেলোয়াড়রা বিজয় অর্জন করতে পারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, ছেলেরা কেন পিছিয়ে পড়বে। এতে ছেলেদের উপর মনস্তাত্তি¡ক চাপ বাড়বে। তারা মাদকের মতো মরণ ছোবল থেকে সরে আসবে। একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে। কোনোপ্রকার মাদক গ্রহণ করলে, খেলাদুলায় অংশ নিতে পারবে না। অর্থাৎ দম ফুরায় বা ফুসফুসের দম বেড়ে যায়, সে দৌড়াতেও অক্ষম হয়ে পড়ে। স্কুলগুলোতেও বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা চলছে। তাদের স্কুলে বার্ষিক কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে হয় প্রতি বছর। আমাদের জেনপ্রাঞ্জলা জয়া- মামণি ব্যান্ড দলের সদস্য। সে বাজাবে মার্কাস। কসরত ও কুচকাওয়াজের তালে তালে। তাদের স্কুল ক্যান্টেনমেন্ট বোর্ড নিয়ন্ত্রিত, অর্থাৎ সেনাশাসিত একটি স্কুলে পড়ে। তাই লেখাপড়া কিছুটা ভিন্নতা আছে। তেমন একটা হৈচৈ নেই। অনেকটা একটি নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যমান। বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয় ডিসেম্বরে শুরুতে, আর রেজাল্ট হয় ১৭-১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে। যেখানে পাবলিক ও প্রাইভেট স্কুলগুলোর পরীক্ষা শুরু হয় ডিসেম্বরে মাঝামাঝি সময়ে, আর রেজাল্ট দেয় ডিসেম্বরের শেষের দিকে। তবে ক্যান্টনরমেন্ট বোর্ডের পরীক্ষা ও ফলাফল কেন আগেভাগে হয়, এ প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষের যুক্তি হলো- শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বদলিজনিত ব্যাপারস্যাপার আছে। যারফলে ফলাফল একটু আগেভাগে দেয়াগেলে অভিভাবকদের বদলিজনিত সমস্যায় পড়তে হয় না। এবং শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতেও বেগ পেতে হয় না। সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নতুন বছরের প্রস্তুতি নিতেও সমস্যায় পড়তে হয় না। এখন তাদের যত নতুন বইয়ের জন্য দৌড়ঝাঁপ ও উৎকণ্ঠা। সঙ্গে অভিভাবকদের তাড়াও বাড়ে। তবে বিগত কয়েক বছর, জানুয়ারির প্রথম সাপ্তাহে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই দেয়ার রেকর্ড আছে। এটি অনেকটা ছন্দ পতন হয়েছে এবার। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সেটি অর্জন বা ধরে রাখতে পারেননি। জানুয়ারি ২০ তারিখের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছেনি। অবশ্য সব বই দিতে না পারলে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত দিয়ে হলেও কিছুটা হালে পানি আসে। বিশেষ করে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা হয় বেশি।
এতে যে সমস্যা কথা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের থেকে বলা হচ্ছে, সেটি হলো তাদের হাতে মাত্র এক বছর সময় আছে মাধ্যমিক পরীক্ষার। এবার নতুন করে দু’বছরের পাঠ্যক্রমের উপর তাদের পরীক্ষা দিতে হবে। এতে করে তাদের উপর অতিরিক্ত চাপ বাড়বে। তার কারণ হলো নবম শ্রেণিসহ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়েও পরিবর্তন এসেছে। তাই তাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্তৃপক্ষ নবম ও দশম শ্রেণির নতুন বইয়ের উপর আগেভাগে জোর দেয়া উচিত ছিল। তবে কোনো শ্রেণিকে রেখে কোনো শ্রেণিকে অগ্রাধিকার দেবে সেটিও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটি স্বীকার করতে হয় জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় ছিল না। জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে পাঠ্যপুস্তকে অনেক পরিবর্তন আনতে হয়। অনেকটা শিক্ষার কারিকুলামেও পরিবর্তন আসে। অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই ‘সাহিত্য কণিকা’য় দুটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়। একটি হচ্ছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অতিথির স্মৃতি’। অন্যটি ‘জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থান’।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট