করোনা মহামারি থেকে শুরু হওয়া শিক্ষার ধীরগতি আর যেন সচলই হচ্ছেনা। দেশের সবকিছু সচল হয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্যে গতি এসেছে, মানুষের যাপিত জীবনে স্বাভাবিকতা এসেছে, কিন্তু বিগত চার বছর ধরে শিক্ষা চলছে নষ্ট চাকার উপর ভর করে। করোনায় একাডেমিক কার্যক্রমে যে অনিয়ম শুরু হয়েছে তাকে নিয়মের মধ্যে ফিরিয়ে আনার সময়ে আবারও অনিয়মে পড়তে হল। সর্বশেষ কোটা আন্দোলনে শিক্ষার দরজা একেবারেই বন্ধের উপক্রম। কারণ শিক্ষা নিকেতন থেকে এ আন্দোলনের সূত্রপাত, শেষে তা রাজপথে গড়ায়। সহিংসতা আর মৃত্যুর মিছিলে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শোকেবিহব্বল। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ডাকা তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে নাগাদ খুলবে তা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আশা করা যায়, আগামীকাল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলবে, আবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মেতে উঠবে। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট থেকে দেশের সকল অফিস আদালতের সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার আদেশ জারি করা হয় সেনা বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে। সেই অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হলেও সরকার পতনের পর অব্যাহত সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। কেননা শুরুতে অনেকের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার ভাব লক্ষ করা যায়। আমরা মনে করি, নতুন সরকার তার অঙ্গীকার পূরণ করবে এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান হবে এবং আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশের অপেক্ষায় আছি। আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসলেও মাধ্যমিকে নতুন কারিকুলামের আলোকে চলছিল অর্ধ সামষ্টিক মূল্যায়ন। উচ্চ মাধ্যমিকে এইচএসসি পরীক্ষাও চলছিল। আন্দোলনে এ দুটি পরীক্ষাও বন্ধ হয়ে যায়। আশার কথা, এইচএসসি পরীক্ষা বাকি বিষয়গুলো সেপ্টেম্বরে নেয়ার ঘোষণা এসেছে। তবে অর্ধ সামষ্টিক মূল্যায়ন কী হবে, তা নিয়ে এখনও কোন নির্দেশনা আসেনি। ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা বিভ্রান্তিতে পড়বে। এ বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি। এরমধ্যে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাতিলের দাবি আসছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। আমরা লক্ষ করে আসছি, বিগত সরকারের নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার যদিও বলেছে, মুখস্থ নির্ভর শ্রেণি কার্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি দূর করে শিক্ষার্থীদের একটি অভিযোজন সক্ষম বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলায় এ কারিকুলামের উদ্দ্যেশ্য। কিন্তু কারিকুলাম নিয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সঠিক গাইড ও নির্দেশনার অভাবে স্বয়ং শিক্ষকরাই কারিকুলামটি বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে পারেন নি। এ অবস্থায় এ কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী ভাবছেন? চলমান কারিকুলামে পাঠ দান বা মূল্যায়ন চলবে নাকি নতুন কোন সংস্কার আসবে-তা যত দ্রুত স্পষ্ট করা হবে, তত আমাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা স্বস্তিতে ফিরবে। শিক্ষকরাও কোনরকম সন্দেহ ও সংশয় ছাড়া পাঠদানে মনোযোগী হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের সাতে কারিকুলামেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে-এ বিষযটি সরকারকে বুঝতে হবে। রবিবার থেকে শিক্ষা প্রাতষ্ঠান খুলবে, সেই ক্ষেত্রে কারিকুলামের বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। বিশেষ করে, ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নে এখনও যেসব বিষয় মূল্যায়ন হযনি, সেই সব বিষয় কখন মূল্যায়ন হবে বা আদৌ মূল্যায়ন হবে নাকি শ্রেনি কার্যক্রম চলবে-সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত নির্দেশনা দিবেন-এমনটি প্রত্যাশা অভিভাবকদের। এছাড়া শিক্ষার্থীরা যাতে আর কোন আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে অংশ না নেয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শ্রেণি কার্যক্রমে মনোযোগ দেয়, সেই বিষয়ে একটি আদেশ প্রদান করা জরুরি। আমরা আশা করি, শিক্ষার যে পক্ষঘাত অবস্থা, যে পিছুটান তা থেকে সুষ্ঠু এবং সুস্থ ধারায় শিক্ষাকে নিয়ে আসতে সরকার আন্তরিকতার সাথে কাজ করবেন। জাতি গঠন আর দেশ গঠন যাই বলি, আগে শিক্ষা ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ঘোড়ার আগে গাড়ি টানা হয়। ফলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। নতুন সরকার বিষয়গুলোর প্রতি বিশষে মনোযোগ দিবেন-এমনটি প্রত্যাশা রইল।