অধ্যক্ষ মোঃ আবদুল কাদের
মানুষ মরণশীল। প্রত্যেক সৃষ্টিই মরণশীল। সৃষ্টির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এর হাত থেকে কেউ রক্ষা পায়নি, পাবেও না। মাস্টার নজির আহমদ একজন মানুষ। সুতরাং তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও তাঁরা মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকে চিরদিন। তাঁদের কর্মকান্ড তাঁদেরকে অমর করে রাখে। তেমনি একজন মানুষ মাস্টার নজির আহমদ। তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল জীবিত মাস্টার নজির আহমদের চেয়ে মৃত মাস্টার নজির আহমদ অনেক জনপ্রিয়। তাঁর মৃত্যুতে জানাজায় মানুষের ঢল নামে। মাস্টার নজির আহমদের সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে, অনেক স্মৃতিও রয়েছে, ক্ষুদ্র পরিসরে যা লিখা সম্ভব নয়। ‘মাস্টার নজির আহমদ কলেজ’ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছে। সব কথার সারমর্মে আমি বলতে পারি মাস্টার নজির আহমদ ছিলেন একজন শিক্ষাব্রতী, মানবপ্রেমী মহান মানুষ। আজ থেকে প্রায় সত্তর বৎসর পূর্বে গ্রামের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন মাস্টার নজির আহমদ। তিনি ছিলেন একজন নির্লোভ মানুষ। সারাজীবন শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। খুব কম কথা বলার অভ্যাস ছিল তাঁর। ছিলেন প্রচার বিমুখ। সব সময় এলাকার দুখি মানুষের কথা চিন্তা করতেন। পরোপকারী মাস্টার নজির আহমদ সাহেবের আতিথেয়তার দৃষ্টান্ত বিরল। মাস্টার নজির আহমদ কলেজ করতে গিয়ে অনেক সরকারি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আগমনে আমি দেখেছি অতিথিদের খাওয়ার টেবিলের চারদিকে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতেন কার প্লেটে কি আছে, নেই । মানবপ্রেমী মাস্টার নজির আহমদ প্রতি বৎসর ঈদ বা ঈদের পূর্বে তাঁর ধন ভান্ডারের দরজা গরিব, দুঃখি ও অসহায় মানুষের জন্য অকাতরে উন্মুক্ত করে দিতেন।
শিক্ষাদরদী মাস্টার নজির আহমদ বিভিন্ন নামে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০০৭ সালের ২ জানুয়ারি মাস্টার নজির আহমদ কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ১ম সভায় উপস্থিত জনতার কাছ থেকে কলেজের নামকরণের ক্ষেত্রে আম্বিয়া-নজির মহিলা কলেজের নাম প্রস্তাব আসলে তিনি বলেন কলেজের নাম হবে নজির আহমদ কলেজ, (মাস্টার শব্দটি আমরা পরে যোগ করি)। আম্বিয়া খাতুনের নামে একটি মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করবো।’ মরহুমা স্ত্রীর প্রতি এ ধরনের প্রগাঢ় বিশ্বাস, আস্থা এবং ভালোবাসা তাঁর মধ্যে লুক্কায়িত ছিল। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর মাত্র চার বৎসরের ব্যবধানে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন বাঁশখালী আম্বিয়া খাতুন মহিলা ক্যাডেট মাদ্রাসা। যেমন কথা তেমন কাজ। শিক্ষা এবং শিক্ষকের প্রতি তাঁর ভালোবাসা লিখে শেষ করা যাবে না।
০৮/১০/২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর মাস্টার নজির আহমদ, আমি এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র আলহাজ্ব মুজিবুর রহমান সিআইপি মাস্টার নজির আহমদ কলেজে প্রথম ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির অনুমতির জন্য আবেদনপত্র নিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে উপস্থিত হই। তখন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড ছিল চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার আট তলা একটা বিল্ডিং এ। বিল্ডিং এর ৬ষ্ঠ তলায় ছিল কলেজ পরিদর্শকের কার্যালয় এবং ৩য় তলায় ছিল স্কুল পরিদর্শকের কার্যালয়।
৮০ বৎসর বয়সের মাস্টার নজির আহমদ লিফ্টবিহীন ঐ বিল্ডিংয়ের ৩য় তলায় উঠার পর ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তখন সহকারী স্কুল পরিদর্শক অধ্যাপক আবুল হোসাইন সাহেব বলেন, আপনি এখানে বিশ্রাম নিন, আমরা আবেদনপত্রখানা কলেজ পরিদর্শকের নিকট জমা দিয়ে আসি।’ তখন মাস্টার নজির আহমদ সাহেব বলেন ‘কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার জন্য আমি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। আমি নিজেই ‘কলেজ পরিদর্শকের অফিসে উপস্থিত হয়ে হাতে হাতে আবেদন পত্র দাখিল করবো।’ তাঁর কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। শিক্ষার প্রতি কত দরদ থাকলে মানুষ এ কথা বলতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
কলেজের শিক্ষকদের তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি বাজারে বা বাড়িতে বড় কোন মাছ পেলে তা শিক্ষকদের জন্য কলেজে পাঠিয়ে দিতেন। শিক্ষকরা তাঁকে আগে কখনো সালাম দিতে পারতো না। কলেজে ঢোকার সাথে সাথে তিনি হাত উঠিয়ে সকলকে সালাম জানাতেন। তিনি বেশিক্ষণ কলেজে উপস্থিত থাকতেন না এবং বেশি বেশি কলেজে আসতেনও না। কারণ তিনি মনে করতেন এতে শিক্ষকরা বিব্রত বোধ করতে পারে। ২৮ মে ২০১৪ তারিখে কলেজে ডিগ্রি চালু করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরিদর্শক দল মাস্টার নজির আহমদ কলেজে গিয়ে নজির আহমদ সাহেবের বিভিন্ন গুণে অবাক ও মুগ্ধ । তিনি পরিদর্শক দলের নিকট জানতে চান তাঁর কলেজটি অনুমতি পাবে কিনা! জবাবে পরিদর্শক টিম বলেন অবশ্যই পাবে। বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত এ মানুষটি ২৭ জুন ২০১৪ ভারতের গোরগাঁও মেদান্ডা মেডিসিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহে … রাজেউন)।
তবে আশার কথা শিক্ষা এবং মানবপ্রীতির ক্ষেত্রে তাঁর সুযোগ্য সন্তানেরা মরহুম পিতার পদাংক অনুসরণ করেই চলেছেন। ১৫ আগস্ট ২০১৪ সালে ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া মরহুমের সুযোগ্য পুত্র আলহাজ্ব মুজিবুর রহমান সিআইপি কথা প্রসঙ্গে ফোনে আমাকে বলেন ‘এলাকার শিক্ষা বিস্তার, সমাজ উন্নয়ন এবং মানবতার সেবায় আমরা মরহুম পিতার আদর্শ ধরে রাখতে সব সময় চেষ্টা করে যাবো।’
লেখক : অধ্যক্ষ, মাস্টার নজির আহমদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বাঁশখালী, চট্টগ্রাম