শিক্ষক নিপীড়ন বন্ধ করুন

3

পরিবর্তনের জন্য যে বিপ্লব সেই বিপ্লব পরবর্তী সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছেন দেশের শিক্ষক সমাজ। অথচ এ শিক্ষকরাই হলেন জাতি গঠনের কারিগর। দেশের মানুষ উদ্বেগের সাথে লক্ষ করে আসছে, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের পর শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের বলপ্রয়োগে পদত্যাগে বাধ্য করানোর মত এক অমর্যাদাকর ঘটনা শুরু হয়েছে, যা এখনও চলমান। ইতোমধ্যে শিক্ষকদের পিটিয়ে মারার ঘটনাও ঘটছে। পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়িতে এমন একটি নিষ্ঠুর ও বর্বর ঘটনা ঘটেছে। বুধবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের ইনস্ট্রাক্টর আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানা নামক এক শিক্ষককে সেই স্কুলের ৭ম শ্রেণির এক ছাত্রের নেতৃত্বে পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফ এর সমর্থিত কর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। শিক্ষার্থীদের দাবি ওই শিক্ষক ছাত্রী ধর্ষণ করেছে, তাই তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। তবে স্থানীয়দের দাবি অভিযোগ ভিত্তিহীন। এর আগেও ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দেয়া হয়েছিল। এবার তাকে সরানোর জন্য পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা নানা চেষ্টা করে সফল না হওয়ায় ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে শিক্ষক সোহেল রানাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর খাগড়াছড়িসহ পুরো পার্বত্য জেলায় আবারও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি বাঙালি মুখোমুখি অবস্থান করছে। এদিকে পুলিশ খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, একজন শিক্ষক মানুষ হিসেবে অপরাধ করতেই পারে। যদি অপরাধ প্রমানিত হয় তবে তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করাই সমীচীন। কোনভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যায় না। সম্প্রতি দেশে মভ জাস্টিসের নামে চল্লিশ জনেরও অধিক মানুষ পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর মাত্র একমাসের মাথায় এতোবেশি মানুষ পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা এটিই প্রথম। যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। খাগড়াছড়িতে যা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায়, এটি প্রতিহিংসার চরিতার্থ করা হয়েছে। এ ঘটনার সাথে জড়িতরা মাত্র ৭ম শ্রেণির ছাত্র বলে জানা গেছে। বয়স বিবেচনায় যারা ১২ থেকে ১৩ বছরের কিশোর হতে পারে। এসব কিশোররাই যদি শিক্ষকদের পিটিয়ে হত্যা করার মত দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন করে, তবে বাবা মায়ের মর্যাদার শিক্ষকরা কোথায় নিরাপদ আশ্রয় পাবেন? একটি জাতি ধ্বংসের জন্য প্রয়োজন শিক্ষক নামক কারিগরদের ধ্বংস করা। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সেই সংস্কৃতির চর্চা হয়েছিল। এখন নতুনভাবে তা অনুশীলন হচ্ছে! এ অবস্থার দ্রæত অবসান হওয়া জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষক নিপীড়ন ও জোর করে পদত্যাগের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই হুশিয়ারি কেউ কর্ণপাত করছে বলে মনে হচ্ছে না।
আমাদের মনে পড়ছে, এ ধরনের অন্যায় রোধ করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটা অফিস অর্ডারও দেওয়া হয়েছিল। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ব্যাপারে সেখানে ছিল সতর্কবার্তা। কিন্তু সুযোগসন্ধানীরা নিজেদের মতো করে লঙ্ঘন করে চলেছে সেই নির্দেশ। কয়েকদিন আগে রেড়িতলা একাডেমির প্রধান শিক্ষক ও তাঁর স্বামীকে একটি ক্লাসরুমে বেঁধে রেখে একজন সহকারী শিক্ষকের নেতৃত্বে কতিপয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবক দিনভর নির্যাতন করে। নির্যাতনের কারণে তাঁদের দুজনের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম হয়েছে। খবর পেয়ে সন্ধ্যার দিকে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল স্বামীসহ প্রধান শিক্ষককে উদ্ধার করে। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা দেখবে তদন্ত কমিটি। সে রকম একটি কমিটি গঠনও করা হয়েছে। খোদ ইউএনও বিষয়টি জানিয়েছেন। তদন্ত কমিটি তাদের কাজও করছে। তাহলে হঠাৎ করে প্রধান শিক্ষককে অপদস্থ করার কারণ কী? যারা নিজের হাতে আইন তুলে নিল, তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা-ও এখন জানা দরকার। শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে খবরটি পৌঁছে দেওয়া দরকার। যে সহকারী শিক্ষকের নেতৃত্বে এই অরাজকতা চলল, তিনি যদি আইনের কাঠগড়ায় না দাঁড়ান, তাহলে সবকিছুই তো মেকি বলে মনে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে যারা নিজ হাতে শাস্তির ভার তুলে নিয়েছেন, তারা যদি শাস্তি না পান, তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের অফিস অর্ডার দেওয়ার কোনো অর্থ থাকে কি? সংস্কারের মাধ্যমে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে অন্তর্বর্তীসরকার। কিছুদিন আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছেন তিনি। ঘুষ, দুর্নীতি, পেশিশক্তির অবসান ঘটবে-এ রকম একটি স্বপ্ন আছে তাতে। কিন্তু গোড়ায় বা তৃণমূলে গলদ থাকলে সত্যিই একটি জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। যে পদ্ধতিতে সরকার পরিচালনায় ঘুষ, দুর্নীতিনির্ভর আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। বহুদিনের অভ্যাস পাল্টানো মুখের কথা নয়। কিন্তু দেশের জনগণ চায় শান্তিতে, নিরাপদে এ দেশে বসবাস করতে। এ রকম একটি আশাজাগানিয়া স্বপ্ন নিয়ে কাজ করার সময় যদি বিভিন্নভাবে অরাজকতা চলতে থাকে, তাহলে তা আশাহত করে। আমরা আশা করি, খাগড়াছড়ির নির্মম ঘটনার দ্রæত তদন্তপূর্বক অপরাধিদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবে প্রশাসন।