মোহাম্মদ ইউসুফ
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, Something is better than nothing. নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো। অর্থাৎ একবারে না পাওয়ার চেয়ে কিছু পাওয়া-ই ভালো। আসলে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অল্পতেই তুষ্ট। চাহিদা খুবই কম। তাই, তারা গত ১২ অক্টোবর থেকে ১০দিনধরে আন্দালন-সংগ্রাম করে ১৫ শতাংশ ভাড়াভাড়া পেয়ে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার ও শিক্ষা উপদেষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কর্মস্থলে ফিরে গেছেন। তা-ও একসাথে নয়, সাড়ে ৭% করে দু’ধাপে পাবেন এ বাড়িভাড়া। চিকিৎসাভাতা ১৫০০ টাকা ও কর্মচারিদের ৭৫শতাংশ উৎসবভাতার বিষয় ধামাচাপা পড়ে গেছে। অথচ শিক্ষকনেতারা মৃত্যুর শপথ নিয়ে বলেছিলেন তিন দফা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বেন না। কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মশার কামড় খেয়ে অবস্থান, কালো পতাকামিছিল, শিক্ষাভবন অভিমুখে ভুখামিছিল, সচিবালয়ের দিকে লংমার্চ ও শাহবাগ মোড়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন, পুলিশের হাতে নানাভাবে লাঞ্চিত হয়ে শেষমেষ ১৫শতাংশ বাড়িবাড়ার সরকারি প্রজ্ঞাপন নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারিরা ঘরে ফিরে যান।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে বর্তমানে শিক্ষকেরা চিৎিসাভাতা পান মাত্র ৫শ টাকা। এতদিন বাড়িবাড়া পেয়ে আসছেন ১০০০ টাকা। অবাককরা বিষয় যে, প্রতিষ্ঠানপ্রধান থেকে শুরু করে পিওন পর্যন্ত সবারই বাড়িভাড়া ১০০০ টাকা। একসময় এ শিক্ষকরা মূল বেতনের ৫০, ৬০ ভাগ, এরপর ৭০ ভাগ পরবর্তীতে ১০০ ভাগ পাচ্ছেন। একসময় শিক্ষক-কর্মচারিরা সরকারি বেতনের অংশ তিনমাসের একসাথে পেতেন। এসব সুযোগসুবিধা শিক্ষকরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাননি, অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করে পেয়েছেন। শিক্ষকেরা যে বেতনভাতা পান তা দিয়ে তো ১০দিন চলাও কঠিন। যেসব শিক্ষকের উত্তাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সহায়সম্পদ আছে, পণিত ইংরেজির শিক্ষকদের যারা প্রাইভেট পড়ান তারা মোটামুটি ভালোই আছেন। কিন্তু যারা প্রাইভেট পড়ান না, শুধু বেতনের ওপর নির্ভরশীল তাদের সংসার কীভাবে চলে- তা সহজেই অনুমেয়।
অভাব-অনটন যাদের নিত্যসঙ্গী তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশিত পাঠদান করবেন? তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় বেতনভাতা না থাকায় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকতা পেশায় আসছে না। ফলে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবী শিক্ষকের বিশেষ করে অঙ্ক-ইংরেজি ও বিজ্ঞানশিক্ষকের তীব্রসঙ্কট চলছে। আমরা সবাই বলে থাকি, শিক্ষা জাতির মেরুদÐ। জাতিকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব শিক্ষকের। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালনকারী মানুষগড়ার কারিগর এ শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির জন্যে রাজপথে আন্দোলন করতে হয়। শিক্ষকদের তো আন্দালন করার কথা নয়। একটি সভ্য দেশে এটি কল্পনাও করা যায় না।
নানামুখি সমস্যা ও বৈষম্যের শিকার বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারিরা। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে একই পাঠক্রমে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ান। কিন্তু তাদের বেতনভাতার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য ও ফারাক। বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা ও উৎসবভাতার ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সরকারি শিক্ষকেরা মূলবেতনের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পান কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র ১০০০ টাকা। সরকারি শিক্ষকের উৎসবভাতা মূলবেতনের সমান। আর বেসরকারি শিক্ষকেরা পার ৫০শতাংশ। চিকিৎসাভাতা দেয়া হয় মাত্র ৫শটাকা।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে শিক্ষক-কর্মচারিরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে ১৫দিন অনশন করেছিলেন বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকেরা। তখন সরকারি তরফ থেকে বলা হয়েছিল শিক্ষকদের জাতীয়করণের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। এদিকে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বিএনপি নেতা শহিদ উদ্দিন চৌধরী অ্যানি এবার আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিএনপি ক্ষমতায় এলে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হবে। এসময় এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব দেলায়ার হোসেন আজিজী বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়ায় বিএনপি নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। এছাড়া তিনি ১৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বাড়ানোর জন্যে শিক্ষাউপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আরবারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ যেমন কম, তেমনি কম শিক্ষকদের বেতনভাতাও। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ সর্বস্তরেই বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলক কম। অথচ উন্নত জাতি গড়তে হলে উন্নত শিক্ষা জরুরি। আর উন্নত শিক্ষার জন্যে প্রয়োজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষক। দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতা অর্জনের ৫৪বছর পরও বাংলাদেশের শিক্ষানীতি নেই। অতীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে শিক্ষানীতি প্রণয়ণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি ৫৪বছর ধরে জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাহাড়ের মতো চেপে আছে।
পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে সরকারকে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে।
লেখক : প্রধান-সম্পাদক, চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম











