শিক্ষকের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা হোক

3

লিটন দাশ গুপ্ত

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষক আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে,
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
আজি হতে চিরউন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির
সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর \
কাজী কাদের নেওয়াজ ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি লিখেছেন অনেক আগে। আজকের দিনে তাঁর লেখা কবিতার শেষস্তবকটি কেন জানি হঠাৎ মনেপড়ে গেল। কবিতার বিষয়বস্তু এই রকম- দিল্লীর বাদশাহ আলমগীরের ছেলে, শাহজাদাকে পড়াতেন এক মৌলভী শিক্ষক। একদিন পড়াতে গিয়ে পায়ে ময়লা কাদা মাটি থাকায় নিজে হাত দিয়ে পা ধুয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু শিক্ষক নিজের পা ধুতে গিয়ে পানি ঢালাচ্ছিলেন শাহজাদাকে দিয়ে। শাহজাদা মানে বাদশাহ’র পুত্র। এমন সময় হঠাৎ বাদশাহ এসে দেখে ফেলেন, তাঁর পুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছিলেন এবং দেখে মনঃক্ষুন্ন হয়ে চলে গেলেন। শিক্ষক, বাদশাহ’র এই অবস্থা দেখে ভয়ে ভাবছিলেন শাহজাদাকে দিয়ে তিনি এমন অন্যায় স্পর্ধার কাজ করায় তাঁর আর নিস্তার নাই। পরক্ষণে ভাবলেন, শিক্ষক তিনি শ্রেষ্ঠ সবার। বাদশাহ যা-ই বলুক, শাস্ত্রের কথা অনর্গল শুনিয়ে বুঝিয়ে দিবেন তিনি অন্যায় করেননি। পরদিন সকালে যথাসময়ে শিক্ষক পড়াতে গেলেন। এইদিকে শিক্ষক যা ভাবলেন তাই হয়ে গেল। অর্থাৎ বাদশাহ দূত পাঠিয়ে শিক্ষককে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের খাস কামরাতে। সেখানে শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বাদশাহ বললেন, আপনাকে পড়াতে দিয়েছি কিন্তু পুত্র আপনার থেকে কি শিক্ষা পেয়েছে! শিক্ষা গ্রহণের বদলে শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনের অবহেলা। শিক্ষক খানিক ভয়ে নম্র স্বরে বাদশাহকে বললেন, জাহাপনা আপনি আমায় নিরালায় ডেকে কি বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছিনা। অতঃপর বাদশাহ বিস্তারিত বুঝিয়েবলেন, গতকাল সকালে দেখলাম আপনি পা ধুয়ে নিচ্ছিলেন, কিন্তু পুত্র আমার, নিজ হাতে আপনার পা ধুয়ে না দিয়ে কেবল পানি ঢালছিল! এটা দেখে বাদশাহ মনঃক্ষুণœ হয়ে মনে বড় ব্যথা পেল জানালেন। এমন কথা শুনে শিক্ষক উচ্ছ্বাস ভরে উপরে কবিতার চরণ চারটি সগৌরবে উচ্চারণ করলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, সময়ের ব্যবধানে কবিতার শেষের চরণে কিছুটা পরিবর্তন চলে এলো। চিরউন্নতকে সরিয়ে যেন চিরঅবনত জায়গা করে নিল। দিল্লীর অধিপতি বাদশাহ আলমগীরের শিক্ষকের প্রতি মহানুভবতায়, সৌজন্যতায় বিগলিত হয়ে যে মৌলভি শিক্ষক একদা উচ্ছ্বাস ভরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আজি হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির।’ সমাজের বাস্তবতায় আজ মনে হয় যেন চির অবনত এখন শিক্ষাগুরুর শির!
কাজী কাদের নেওয়াজের শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতাটি আমরা পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম। আজও ছাত্রছাত্রী পড়ে, কারণ আজো কবিতাটি প্যাবইয়ের পাতায় আছে; তবে আছে বড় অযতেœ! এখন কেউ পড়ে কেউ পড়ে না। আর যারা পড়ে তারা আগ্রহ নিয়ে পড়েনা। তাই শিক্ষকের প্রতি আগের সেই মর্যাদাও নেই। আবার অনেকে বলেন, ক্ষেত্রবিশেষে আগের মত সেই শিক্ষকও নেই।
শিক্ষক হচ্ছে পরিবারের মাতা পিতার সমপর্যায়ের ব্যক্তি। সমাজে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যে ব্যক্তি শিক্ষকের কাছে পড়ালেখা করেনি। হতে পারে সমাজের নিম্নপর্যায়ের মানুষ অথবা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের আসীন যে কোন ব্যক্তি। এককথায় যদি বলি, পিতা মাতা ছাড়া শিশুর যেমন জন্ম হয়না, তেমনি শিক্ষক ছাড়া কেউ মানুষ হয়না। তাই মাতাপিতার পরে শিক্ষকের স্থান বলা হয়ে থাকে। এই কারণে অনেকে সমাজে মাতা-পিতার মত শ্রদ্ধা পেতে শিক্ষকতা পেশাকে মহান ব্রত হিসাবে গ্রহণ করে বা করেছে। উল্লেখ্য উত্তম শিক্ষক সবসময় জ্ঞানী হয়ে থাকেন। উৎকৃষ্ট বীজ থেকে যেমনই উত্তম বৃক্ষের জন্ম নেয়, একইভাবে একজন উত্তম শিক্ষক থেকে একটি উৎকৃষ্ট সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সমাজ বিনির্মাণে উৎকৃষ্ট উত্তম শিক্ষকের বিকল্প নেই। আর একজন উত্তম মানুষই হতে পারেন, একজন উৎকৃষ্ট শিক্ষক। যে সমাজে উৎকৃষ্ট শিক্ষকের সংখ্যা যত বেশি সে সমাজ ততই উন্নত ও সমৃদ্ধ। তাই কেবল চাকরি হিসাবে শিক্ষকতা নয়, একজন উৎকৃষ্ট মানুষ সুশিক্ষক হতে গেলে ঐ মানুষকে অবশ্যই পেশাগত হিসাবে মনেপ্রাণে শিক্ষক হতে হবে। সুশিক্ষক হয়ে উত্তম চিন্তা ও উৎকৃষ্ট কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারলে সমাজে উত্তম মানুষ তৈরি হবে। আর উত্তম মানুষ তৈরি হলেই শিক্ষকের শিক্ষকতা পেশা সার্থকও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
আমার এখনো মনে আছে, অনেক বছর আগে আমি একটি বেসরকারি কলেজে প্রভাষক পদে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে মৌখিক পরীক্ষায় জানতে চেয়েছিল একজন আদর্শ শিক্ষক হতে গেলে নিজেকে কী হতে হবে। আমি বলেছিলাম ‘প্রথমতঃ জ্ঞানী হতে হবে, দ্বিতীয়তঃ জ্ঞান বিতরণের সক্ষমতা ও দক্ষতা থাকতে হবে।’
আমি মনে করি জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই মুক্তি। কারণ জ্ঞানের মধ্যে লুকিয়ে আছে সত্যিকারের বিবেক আবেগ ও পথ চলার মানুষ হবার সঠিক নির্দেশনা। জ্ঞানবান না হলে কেউ ভক্তি শ্রদ্ধা করবেনা। তাই শিক্ষককে জ্ঞানবান হতে হবে। জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সাথে তুলনা করা হয়। জ্ঞান ও বিজ্ঞান সমৃদ্ধ জাতি আজ পৃথিবীর বুকে চালকের আসনে আসীন হয়ে আছেন। তবে একজন শিশু সত্যিকারের মানুষের মত মানুষ হওয়া কেবল জ্ঞানী শিক্ষকের উপর নির্ভর করেনা। এখানে রয়েছে পরিবার পরিবেশ পরিজন শিক্ষাক্রম শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি। গত কয়েক বছর নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমগ্র দেশের মানুষ অস্বস্তি ও বিব্রত অবস্থায় পড়েছিল। সমগ্র দেশের মানুষ বলছি এই জন্যে, দেশের এমন কোন ঘর বা পরিবার নেই যেখানে একটি শিশু বা সন্তান প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত কোন না কোন শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেনা। এই জন্য নতুন শিক্ষাক্রম আমাদের দেশের সার্বিকভাবে উপযোগী না হওয়ায় দেশের অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবক অস্বস্তি ও বিব্রত অবস্থায় পড়েছিল। এইক্ষেত্রে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করলেও ঋণাত্মক প্রভাব বেশি পড়েছে শিক্ষকদের উপর। শুধু শিক্ষাক্রমে নয়, মূল্যায়ন পদ্ধতি থেকে শিক্ষাব্যবস্থায়ও ঘাটতি রয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে। ইতোপূর্বে একবার সৃজনশীল আর একবার একমুখী শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি। এমন অবস্থায় মনেপড়ে গেল আব্দুল আলীমের একটি গানের অংশবিশেষ ‘ছায়াবাজী পুতুল রূপে বানাইয়া মানুষ, যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কি দোষ’। এইদিকে বিভিন্ন সরকার তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করে। এইসব কারণে কিছু সাধারণ মানুষ মনে করে, যা কিছু হচ্ছে তার জন্য শিক্ষকই দায়ী; মানে যা দোষ পুতুলেরই দোষ!
অন্যদিকে এমন কিছু শিক্ষক আছে, যাদের নৈতিকস্খলন ঘটেছে। যেমন- অর্থলোভে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা, টাকার বিনিময়ে ভর্তি করা, বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও সমস্যাসৃষ্টি করা ইত্যাদি। এসবের কারণে আমাদের ছেলেদের নীতি-নৈতিকতা আর গুরুভক্তি বা শিক্ষকের প্রতি মর্যাদা জিনিসটা দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অথচ আমরা দেখছি শিক্ষকদের শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ নেই। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে প্রতিমাসের বেতন নিয়ে মোটামুটি ভাবে সংসার চালাতে গিয়েও হিমশিম খেতে হয়। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তারপরেও তাদের উপর থাকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুমুখী চাপ। আমাদের দেশে সকল শিক্ষক রাজনীতি করেনা। সম্ভবত বেসরকারি কিছু শিক্ষকের রাজনীতি করার সুযোগ রয়েছে, তাই রাজনীতির সাথে গুটি কয়েকের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। কিন্তু এই যাবৎ কালে কখনো দেখিনি বা শুনিনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে জনসম্মুখে গুলি করে মানুষ হত্যার মত অপরাধ করেছে; কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছে! তারপরেও আগস্ট মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পর সাড়া দেশে দেখলাম, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বা হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষককে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা, রাজনীতির অপবাদ লাগিয়ে নানাভাবে অপদস্থ করা, জুতোর মালা গলায় পরিয়ে দেয়া, চড়- থাপ্পড় আর কিল-ঘুষি দিয়ে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো ইত্যাদি যা জাতির জন্যে কলঙ্কজনক বিষয় এবং বাংলাদেশের জন্য একটি অশুভ সংকেত। কারণ, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষক সেই মেরুদন্ড সঠিকভাবে গঠনের কারিগর। আগেই বলেছি পিতা মাতা ছাড়া শিশুর যেমন জন্ম হয়না, তেমনি শিক্ষকের শিক্ষা ছাড়া মানুষ হওয়া যায়না। সেই হিসাবে একজন শিক্ষক হলেন- দ্বিতীয় পিতামাতা। আজ সেই পিতামাতাকে আঘাত করা হচ্ছে, অসম্মান আর অপদস্থ করা হচ্ছে। একজন শিক্ষকের সম্মানহানি হওয়া মানে পুরো জাতির কলঙ্ক। যারা শিক্ষকদের সাথে এহেন আচরণ করতে পারে, তাদের কাছে তাদের পরিবার এমন কি মাতাপিতাও নিরাপদ নয়। যেকোনো সময় তারা তাদেরকেও আঘাত করতে পারে। আমরা পত্রপত্রিকায় অনেক সময় দেখিছি, ছেলে মেয়ের হাতে মা-বাবা খুন হচ্ছে, মাবাবাকে চরম অপদস্ত করা হচ্ছে, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হচ্ছে, সম্পত্তি বন্টনকে কেন্দ্র করে মাতা পিতা মৃত্যুর পর দিনের পর দিন শেষকৃত্য না করে, লাশ ফেলে রাখা হয়েছে ইত্যাদি। যারা জ্ঞানীদের সম্মান দিতে জানেনা তারা মাতাপিতাকেও সম্মান করেনা। এরা একপ্রকার বর্বর। ড. মুহাম্মদ শহীদুলাহ বলেছেন, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না।’ এইভাবে চলতে থাকলে হয়ত দেশে উত্তম শিক্ষক পাবনা, সুশিক্ষকের অভাবে গুনী মানুষ জন্ম নিবেনা বা সৃষ্টি হবেনা।
তাই পরিশেষে আজ পরামর্শক্রমে বলতে চাই, শিক্ষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সমগ্র শিক্ষা, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন ভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে হুমাযুন আজাদের সেই কথাটা সত্য না হয়- ‘শিক্ষকের জীবনের থেকে চোর, চোরাচালানি, দারোগার জীবন অনেক আকর্ষণীয়। কারণ এই সমাজ শিক্ষক চায়না, চায় চোর চোরাচালানি দারোগা।’

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট