শাহ সাহেব কেবলা (রা.) ও ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী (সা.)

1

মাওলানা এম সোলাইমান কাসেমী

মহান আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাতের স্মৃতিময় দিন সোমবার। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের একই দিনে ইহকাল ত্যাগ করেন। ১২ রবিউল আউয়াল মুসলিম বিশ্বে এক আবেগময় আবহ সৃষ্টি করে। কারণ এই দিনে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের আনন্দ এবং তিরোধানের বেদনা বহন করে আনে। ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.) মানব ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ এবং স্মরণীয় দিন। নবীকুল শিরোমণির পৃথিবীতে আগমন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ-উৎসব। মানবতার মুক্তিদূতের পুণ্যময় স্মৃতিবিজড়িত এ দিবস শুধু মুসলিম নয়; বরং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত।
‘রবি’ আরবি শব্দ। অর্থ হচ্ছে বসন্ত, সঞ্জীবনী ও সবুজের সমারোহ। রবিউল আউয়াল অর্থাৎ প্রথম সঞ্জীবনীর মাস। এ নামকরণের তাৎপর্য হচ্ছে, মক্কার কাফির ও কোরাইশরা অনাবৃষ্টি খাদ্যের অভাবের কারণে কঠিন বিপদের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলো। রাসুলেপাক (সা.) যে বছর মা আমিনা (রা.) কোলে আগমন করলেন, সে বছর মক্কার শুষ্ক জমি সঞ্জীবিত হয়ে উঠলো এবং শুষ্ক বৃক্ষ তরতাজা হলো। আর চতুর্দিকে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার অসংখ্য আলেম-ওলামা ও সুফী-সাধকগণের স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম হচ্ছে চুনতী। এ জনপদের ঐতিহ্যবাহী চুনতীর একজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও বিশাল সুখ্যাতির অধিকার ছিলেন হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.)। শাহ সাহেব হুজুর হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ মহান ব্যক্তিত্বের বড়গুণ ছিলো তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত আশেকে রাসুল (সা.)। আর তাঁর রাসুল প্রেমের এক অনুপম নিদর্শন হচ্ছে- চুনতীর ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সা.)।
বাংলাদেশে পবিত্র সীরাতুন্নবী (সা.) নামক মাহফিলের তিনিই ছিলেন মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের মাস পবিত্র রবিউল আওয়াল মাসে তিনিই প্রথম সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলের উদ্যোগ করেন ১৯৭২ সালে। ১৯৭৩ সালে ২ দিনব্যাপী, ১৯৭৪ সালে ৩ দিন ব্যাপী, ১৯৭৫ সালে ৫ দিন ব্যাপী, ১৯৭৬ সালে ১০ দিনব্যাপী এবং ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে ১২ দিন ব্যাপী মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সা.) উদযাপিত হয় পবিত্র রবিউল আওয়াল মাসে। ১৯৭৯ সালে ১৫ দিনের কর্মসূচির ভিত্তিতে মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সা.)-এর কার্যক্রম আরম্ভ হয় কিন্তু শাহ সাহেব হুজুর মাহফিলের শেষ পর্যায়ে দুই দফায় দুই দিন করে বাড়িয়ে একে ১৯ দিনের মাহফিলে রূপান্তরিত করেন। এরপর থেকে অদ্যাবধি ১১ থেকে ৩০ রবিউল আওয়াল পর্যন্ত ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সা.) চলছে।
হযরত শাহ সাহেব হুজুর ইন্তেকাল করেন ১৯৮৩ সালের মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সা.) -এর ১৯ দিন আগে। শাহ সাহেব হুজুরের ইন্তেকালের পর বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই ও বাধা- বিপত্তি সত্ত্বেও অদ্যাবধি এই মাহফিলের অব্যাহত থাকাটা নিসন্দেহে তাঁর বড় কিরামত তথা বুজুর্গীর বড় নিদর্শন।
পৃথিবীর ইতিহাসে ধারাবাহিক ও বিষয়ভিত্তিক রাসূল (সা.)-এর মিলাদ ও সীরাত বিষয়ে আলোচনার ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলের আয়োজন চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতী সীরাতুন্নবী (সা.) ব্যতীত আরেকটি আছে কিনা আমাদের জানা নেই। কুরআন সুন্নাহর আলোচনার পাশাপাশি লক্ষাধিক মানুষের আপ্যায়নের ব্যবস্থাপনার এক বিরল দৃষ্টান্ত। ১৯৭২ সাল থেকে এই পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসা এই মাহফিল কুরআনের চলমান মুজিযার একটি অংশ ও অলিকুল শিরোমণি মুজাদ্দিদে মাহফিলে সীরাত হযরত হাফেজ আহমদ (শাহ সাহেব) (রা.)- এর জীবন্ত কারামত।
আবহমানকাল থেকে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগামী চুনতীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য ইসলাম প্রচারের ইতিহাসেও সমৃদ্ধ।
হযরত শাহ সাহেব (রা.) বলেছিলেন, চুনতী খাঁর দিঘীর মসজিদ (বর্তমান মিডওয়ে হোটেলের দক্ষিণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডের পশ্চিম পাশে) রাসূল (সা.)-এর প্রিয় দু’জন সাহাবীর কবর রয়েছেন। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, চারজন সাহাবী (রা.) চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেছেন। তাঁদের অন্য দু’জনের কবর বর্তমান চীনের ক্যান্টন অঞ্চলে রয়েছেন। আল্লাহর অলীগণ কাশফের মাধ্যমে সর্বসাধারণের ধারণার বাইরে অজানা তথ্য দিতে সক্ষম, যা তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। শাহ সাহেব (রা.) কাশফের জগতে অনেক উঁচু স্তরের একজন আল্লাহর অলি ছিলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। রাসূল (সা.)- এর সাহাবা ও অলিগণের পদচারনায় মুখরিত এই চুনতীর সীরত মাহফিল,যা চুনতীর পরিবেশ দেখলেই বুঝা যায়।
১৯ দিনব্যাপী সীরতুন্নবী (সা.)- মাহফিলের চতুর্মাত্রিক আয়োজন শুধুমাত্র টাকা আর শ্রম দিয়ে সম্ভব নয়। এই মাহফিলের উপর রয়েছে মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত ও প্রিয় নবী (সা.)- এর বিশেষ দৃষ্টি। খাবার তৈরি ও ব্যবস্থাপনা,পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, জালানী জোগাড়, খাবার পরিবেশনা, আলেম, আলোচক, মেহমান ও দাতাদের যথাযথ আপ্যায়ন ও থাকার ব্যবস্থা, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, অজু ও ইবাদতের সুব্যবস্থা ইত্যাদি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। শতশত স্বেচ্ছাসেবক নিজের অর্থ, সময় ও শ্রম দিয়ে প্রতিনিয়ত নির্ধারিত জায়গায় আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন কবুলিয়তের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। হযরত শাহ সাহেব (রা.)-এর জীবদ্দশায় একদিন সীরাত মাহফিলে তাঁর অজান্তে ছোট বাচ্চাদের খাবার পরিবেশন না করায় তিনি অভিমান করে কয়েকদিন সীরাতের খাবার গ্রহণ করেননি।
প্রতি বৎসরের ন্যায় এ বৎসরও অত্র মাহফিলে প্রিয় নবী হযরত (সা.)-এর পবিত্র জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক ও বিভাগ এবং তাঁর আনীত পবিত্র জীবন ব্যবস্থা ইসলামের জরুরী বিভিন্ন বিষয়ের উপর সারগর্ভ আলোচনা রাখবেন অসংখ্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ আলোচকবৃন্দ। বিজ্ঞ পরিচালকের তত্ত্বাবধানে এবং প্রাজ্ঞ সভাপতির সভাপতিত্বে এ মাহফিল পরিচালিত হবে কালামে পাকের তেলাওয়াত ও না’তে রসুল (সা.)-এর মাধ্যমে। প্রতিদিন মাহফিল শেষ হবে সভাপতির বক্তব্য ও নবীজী (সা.)-এর প্রতি সালাত-সালাম পেশ আর দুআ-মুনাজাতের মাধ্যমে। মাহফিলে অতিথি , শ্রোতা ও বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্য রয়েছে আম জিয়াফত। নারীদের জন্যও আছে ওয়াজ শুনা ও জিয়াফতের আলাদা ব্যবস্থা।
১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সা.)-এর এই আলীশান আয়োজনটি পরিচালিত হয় রাসুল প্রেমিক মুসলিম জনতার আর্থিক সহায়তার উপর ভিত্তি করে।
এ মহান স্মৃতিবিজড়িত মাহে রবিউল আউয়ালকে শুধুমাত্র মিলাদুন্নবী (সা.), সীরাতুন্নবী (সা.), সভা, সমাবেশ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে এবং বছরের একটি মাস রাসুল (সা.)-এর মিলাদ ও সীরাত বর্ণনা করে আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হবে না; বরং এ মাহে রবিউল আউয়ালকে আমাদের নবীজীর আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণের একটি প্রেরণার উৎসে পরিণত করতে হবে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহিমাময় জীবনাদর্শ আমাদের ব্যক্তিজীবনে অনুকরণ-অনুসরণ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে তার প্রতিফলনের মাধ্যমে এ পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের হক আদায় করতে হবে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, চবি