শাহজাহান ইসলামাবাদী : দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক কিংবদন্তি যোদ্ধা ও ইতিহাস

1

সোহেল মো.ফখরুদ-দীন

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অসংখ্য সাহসী যোদ্ধার নাম উঠে আসে, যাঁরা আত্মত্যাগের মাধ্যমে জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়েছেন। তাঁদেরই অন্যতম ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ইসলামাবাদী। তিনি শুধু একজন বীর যোদ্ধা নন, ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, যাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘শাহজাহান গ্রুপ’। এই গ্রুপের কার্যক্রম দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধকে শক্তিশালী করেছে এবং পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।

প্রারম্ভিক জীবন ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট : শাহজাহান ইসলামাবাদী জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানার বরকল গ্রামে। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, দার্শনিক ও প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সাংবাদিক মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সুযোগ্য পুত্র। পারিবারিকভাবে সংগ্রামী ও আদর্শবাদী চেতনার ধারক হওয়ায় স্বাধীনতার আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল স্বাভাবিক।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় নেতৃত্বের সূচনা : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সমগ্র দেশ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা চালায়। চট্টগ্রাম শহরও পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে শাহজাহান ইসলামাবাদী নিজ এলাকা বরকলে ফিরে যান। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সংগঠন।
প্রথমদিকে হাতে সীমিত অস্ত্রশস্ত্র থাকলেও তিনি দ্রæত স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী দল গঠিত হয়, যা পরে “শাহজাহান গ্রুপ” নামে পরিচিতি লাভ করে। এই গ্রুপের সদস্যরা ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ও স্থানীয়ভাবে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।

শাহজাহান গ্রুপের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা : শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, চন্দনাইশ, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক অপারেশন পরিচালিত হয়। এই দল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ : প্রাথমিকভাবে শাহজাহান গ্রুপের হাতে সীমিত অস্ত্র ছিল—দুইটি এসএলআর (ঈ-৩ অঁঃড় এঁহ), তিনটি গ্রেনেড এবং কিছু গুলি। কিন্তু দ্রুত অস্ত্রসংগ্রহের কৌশল অবলম্বন করে তারা অপারেশন পরিচালনা করতে থাকে। আনোয়ারার খাসখামা ও বৈলতলী থেকে অস্ত্র সংগ্রহের মাধ্যমে গ্রুপটি আরও শক্তিশালী হয়। এরপর ভারত থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধা দলের সঙ্গে সমন্বয় করে ৭টি রাইফেল এবং এক হাজার ৩০৩ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করা হয়।

গেরিলা যুদ্ধের সফলতা : শাহজাহান গ্রুপ দক্ষিণ চট্টগ্রামে গেরিলা কৌশল প্রয়োগ করে বিভিন্ন সফল অপারেশন চালায়। পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো, রাজাকার ও আল-বদরদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা, শত্রুর অস্ত্রাগার আক্রমণ করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা ছিল তাদের মূল কর্মকান্ড।
পাকিস্তানি বাহিনী একাধিকবার শাহজাহান গ্রুপকে নির্মূলের চেষ্টা চালায়, কিন্তু তাদের দৃঢ়তা ও কৌশলগত দক্ষতার কারণে শত্রুরা ব্যর্থ হয়। যুদ্ধের শেষের দিকে শাহজাহান গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৩০০-৪০০-তে পৌঁছায় এবং তাদের অস্ত্রভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

শাহজাহান ইসলামাবাদীর অনন্য নেতৃত্ব ও সংগঠন দক্ষতা : শাহজাহান ইসলামাবাদী শুধু একজন যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি দক্ষ সংগঠকও ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আঞ্চলিকভাবে দায়িত্ব বণ্টন করেন।
যুদ্ধের শেষের দিকে শাহজাহান গ্রুপের সফল অপারেশনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর লজিস্টিক সরবরাহ ব্যাহত করা রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রাগার গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান।

যুদ্ধোত্তর জীবন ও মৃত্যুবরণ : মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের পর শাহজাহান ইসলামাবাদী জাতীয় পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তিনি ১৯৮৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানকে স্মরণ করে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ তাঁর মৃত্যুর পর দৈনিক আজাদীতে সম্পাদকীয় লেখেন, যেখানে তাঁকে ইতালির জাতীয় বীর গ্যারিবোল্ডির সঙ্গে তুলনা করা হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শাহজাহান ইসলামাবাদীর অবদান অবিস্মরণীয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামে তাঁর নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধকে শক্তিশালী করেছিল এবং পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের ইতিহাসে এই মহান মুক্তিযোদ্ধার অবদান যথাযথভাবে আলোচিত হয়নি।
স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরের বেশি সময় পরও তাঁর বীরত্বের স্মরণে যথাযথ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। শাহজাহান ইসলামাবাদী শুধুমাত্র এক অঞ্চলের নায়ক নন, তিনি গোটা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর সাহস, নেতৃত্ব ও ত্যাগের গল্প আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র