শারদীয় স্মৃতি কাতরতা

51

বৃষ্টিস্নাত বর্ষার পর বাংলায় আসে শরৎ কাল। প্রকৃতি যখন বর্ষণে স্নাত হয়ে পুত পবিত্র হয়ে যায়, শরৎ তখন তার আগমনী বার্তা প্রকৃতিতে শ্রæত হয়। মহান আল্লাহ তা’য়ালা কোরানের বিভিন্ন আয়াতে বলেছেন, পৃথিবীকে সুজলা সুফলা করার জন্য তিনি বৃষ্টি দান করেন। বৃষ্টির পানি রুষ্ট মাটিকে সজীব করে তোলে। বৃক্ষ তরুলতা বৃষ্টির পানি পেয়ে সঞ্জীবিত হয়ে উঠে। খাল-বিল, নদী, হ্রদ, সাগর, মহাসগর পানিতে থৈ থৈ করে। এই বৃষ্টি না হলে কী হতো, তা সহজেই কল্পনা করা যায়। বাংলায় প্রবাদ আছে বৃষ্টির জলের জন্য চাতক পাখি হাহাকার করে। শুধু চাতক কেন আমার ধারণা পৃথিবীর সকল জীব-জন্তু, প্রাণীজগত, ধরনী মোদ্দা কথায় সকল সৃষ্টি বৃষ্টির জলের জন্য উম্মুখ হয়ে থাকে। এই বৃষ্টি যেমন প্রকৃতির আশীর্বাদ তেমনি অভিশাপও বটে। যে সকল জাতি প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ করে, বৃষ্টির জল তাদের জন্য অভিশাপ নয় কী ? উদাহরণ হিসাবে চট্টগ্রামের কথাই বলা যাক ; আমরা খাল বিল নালা নর্দমা পাহাড় জবর দখল করে পাথরের দালান তৈরী করে চলেছি। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা ও জলজট লেগে যায়। এমনি করে পৃথিবীতে যারা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করেছে তারা সকলেই ভোগান্তিতে পড়েছে।


সাম্প্রতিক বিশ্বে উষ্ণায়নের জন্য মানব জাতি সোচ্চার। উত্তরের হিম গলে গলে পড়ছে। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও পানির উচ্চতা বাড়ছে। চট্টগ্রামের কথাই ধরা যাক। বর্ষায় কিম্বা জোয়ারে, পূর্ণিমার কাটালে খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আগ্রাবাদসহ নগরের নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এর মূল কারণ প্রকৃতির প্রতি আমাদের অশ্রদ্ধা।
শরতের আকাশ বাঙালি মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আছে। মেঘ মুক্ত নীল চাঁদোয়ায় তখন সাদা সাদা জলমুক্ত মেঘের কৈথুর ভেসে বেড়ায়। প্রকৃতি এক পরিচ্ছন্নতায় ভরে উঠে। উত্তর হতে ভেসে আসে হালকা হিমেল পবন। যার পরশে মানব মনে লাগে দোলা। এই শীতল পরিবেশে ঘুম ঘুম ভাব জাগুরিত হয়। কখনো কখনো শিশির ঝরে। আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে শরতে শিশির ঝরে পড়ার নমুনা দেখা যেত। দুর্বা ঘাসে কিংবা ঝোপ-ঝাড়ের মাড়কশার জালে শিশির ঝুলে থাকার চিত্র দেখা যেত। শরতে সনাতনী ধর্মালম্বীদের দুর্গাপূজার জন্য বিখ্যাত। শরতের কুয়াশা মাখা ভোরে ঘুম ভাঙ্গতো মহালয়ার সুর শুনে। মহালয়ার আনন্দময়ী সুর ভেসে আসতো পাড়ার পুজামÐপ থেকে।
দুই : বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের দেশ সমূহের ঋতুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শীতের সময় শীত নেই আবার বর্ষার সময় বর্ষা নেই। কাম্যস্তরের বৃষ্টি পাত নেই। ফলে প্রকৃতির নানা নিয়মকানুন বদলে যাচ্ছে। ঋতু ভিত্তিক চাষাবাদে পড়ছে বিরুপ প্রতিক্রিয়া। শস্য উৎপাদনেও দেখা দিচ্ছে নেতিবাচক প্রভাব। সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ টানা যাক। ভারতে সীমাহীন বৃষ্টিপাতের ফলে পেঁয়াজ উৎপাদনে ঘাটতি পড়ে। ভারত তার দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে অদ্যাবধি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। প্রথম ধাক্কায় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা বিক্রি হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। অবশ্য এটা আমাদের জন্য শুভ সংবাদ।
ভারত এক সময় বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানী বন্ধ করে দেয়। ফলে ৪/৫ বছরে বাংলাদেশে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়। দেশের আনাচে কানাচে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুবক ও উদ্যোগীরা গরু খামার গড়তে এগিয়ে আসে। ফলে দেখা যায় গত ২/১ বছর যাবৎ আমদানীকৃত গবাদি পশুর জন্য হাহাকার করতে হয় নি। দেশীয় গবাদি পশুতে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। আমি আশা করবো ভারত তার পেঁয়াজ রপ্তানীতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখতে। এই সুযোগে দেশের কৃষক সমাজ পেঁয়াজ উৎপাদনে গভীরভাবে মনযোগ দিয়ে রের্কড সৃষ্টি করবে। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম। বাংলাদেশে বর্তমানে চাল ও আলু উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ভবিষ্যতে তারা পেঁয়াজ উৎপাদন করে দেখিয়ে দেবে।
তিন : কথা বলছিলাম ঋতুচক্র নিয়ে। ঋতুচক্রের হিসাবে দেশে বর্ষা আশার কথা জুনের শুরুতে। আবার অনেক সময় দেখা যায় সে মাসের মাঝামাঝি সময়েও বর্ষা চলে আসে। বাংলাদেশে ঋতু চক্রের মধ্যে বর্ষা সবচেয়ে বড় তথা বেশি প্রলম্বিত ঋতু। অন্যান্য ঋতু সমূহ এতো দিন দীর্ঘায়িত হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে সে নিয়ম যেন মানছে না প্রকৃতি। যেমন এবার বর্ষা এসেছে বিলম্বে। বলা যায় ২০ জুনের পর বর্ষা সক্রিয় হয়। যার রেশ অক্টোবর পর্যন্ত চলছে। আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাসে বলছেন, আরও কয়েক দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের বর্ষা যেমনে দেরিতে এসেছে তেমনি দেরিতে বিদায় নেবে তা নয়। বর্ষার সূচী লক্ষ্য করে দেখা গেছে বিগত ১২/১৫ বছর ধরে বর্ষার আসা যাওয়া দেরিতে হচ্ছে। এ ছাড়া বর্ষার ধরনও পাল্টে গেছে। আমাদের শৈশবে দেখেছি টানা বর্ষার। অর্থাৎ একটানা তিনদিন, পাঁচদিন থেকে শুরু করে সাত কিংবা দশদিন বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখন তা আর লক্ষ করা যায় না। যার প্রভাবে রবিশষ্য উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। শুধু তাই নয়, অসময়ে বৃষ্টিপাত ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিক ভাবে বর্ষার শেষ হতো ইংরেজি সেপ্টেম্বর মাসে। এখন তা শেষ হতে অক্টোবর পর্যন্ত লেগে যায়। দেশের আবহাওয়া দপ্তর পূর্বাভাসে বলছেন, চলতি মাসেও স্বাভাবিক বৃষ্টি হতে পারে। আবার বঙ্গোপসাগরে অক্টোবরে ২/১টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। তার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে বেশ কিছু ঘূর্ণিঝর হওয়ার সংবাদ আছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশ সমূহে যেখানে ঘূর্ণিঝড় হত না বললেই চলে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের প্রবল সৃষ্টিপাতের এবং প্রাণহানীর সংবাদ পাওয়া যায়। গত মাসে দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
জলবায়ুতে পরিবর্তন হেতু বিশ্ব এমন উষ্ণায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উত্তর মেরুর বরফের চাই গলে গলে ভাসমান অবস্থায় দক্ষিণে সরে যাচ্ছে। হিমালয় পর্বতমালার বরফও গলে যাচ্ছে। ফলে বিশ্বে অনেক দেশে নিম্নাঞ্চলে পানিরচাপ বৃষ্টি পেয়ে ডুবিয়ে দিচ্ছে উপক‚লীয় এলাকা। চট্টগ্রামের ব্যবসার হাব খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই এবং আগ্রাবাদ অঞ্চ্ল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একমাত্র মানব সমাজই দায়ী। নদী নালা যেমন দখল করছে তেমনি বন বনানী কেটে কুটে সাফ করে শিল্প কারখানা ও নগরায়ন গড়ে তোলা হচ্ছে। তাই প্রকৃতি তার বিরুদ্ধে ফুলে উঠছে। অতএব সাবধান বিশ্বমানব জাতি।

লেখক : কলামিস্ট