
মিঞা মুহাম্মদ জামশেদ উদ্দীন
পশ্চিমা দুনিয়ার তরুণ ও কিশোরদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করেছেন আধ্যাত্মিকতা ও সর্বধর্মের আচার-অনুষ্ঠান। বিশেষ করে পিস দৌড়ে শান্তিবাহি মশাল ও হারমোনিয়াম উদ্ধৃত করে। পাশাপাশি মেডিটেশন বা ধ্যান হয়ে ওঠে প্রার্থনার প্রধান কার্য। এ অনবদ্য সৃষ্টিশীল ও কীর্তিমান ব্যক্তি অন্য কেউ নয়, চট্টগ্রামের পটিয়ার শাকপুরা গ্রামের শ্রী চিন্ময় ঘোষ।
যিনি নিজের হাতের মুঠোয় আনতে পেরেছেন অসীম ইচ্ছে ও প্রবল বাসনাকে, যা কিনা তাঁকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। এ বিশ্ব বরণ্যব্যক্তি স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে ওঠে। তাঁর নামে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেড়শ সড়কের নামফলক, মেডিটেশন সেন্টারসহ স্ট্যাচু স্থাপন করা হয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গিতাজ্ঞ, গীতিকার, চিত্রশিল্পী, হারমানিয়াম ও অ্যাথলিটবীদ। তিনি পিস রান প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে দৌড়বিদরা একটি জ্বলন্ত শিখা বহন করে শান্তির বার্তা দেয়, ‘বিশ্বশান্তি শুরু হয় আমি থেকে।’ তাঁর উচ্চমার্গের এ সৃজনশীলকর্ম বিশ্ববাসীর কাছে ভ‚য়সী প্রশংসনীয় হয়। এমন কি জাতিসংঘের অর্থায়নে পিস দৌড় ও মেডিটেশনকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবং ১৯৭১ সালে জাতি সংঘের মহাসচিব উ থ্যান্টের আমন্ত্রণে সাপ্তাহে দুদিন ধ্যান বা মেডিটেশন পরিচালিত হতো। এতে সকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা অংশ নিতেন। এটি শ্রী চিন্ময় ঘোষের উপস্থিতে পরিচালিত হতো। এসব অসীম উদ্ভাবনী কর্ম তাঁকে এনে দেয় সুনাম- খ্যাতিসহ বিশ্বের শান্তির দূর্ত হিসেবে।
পাশাপাশি শৈল্পিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি এক বছরে ১ লক্ষ বিমৃর্ত চিত্রকর্ম অঙ্কন করেন। যা তাঁর হৃদয় থেকে আনন্দ, সৌন্দর্য এবং অনুপ্রেরণা প্রকাশ করে। তিনি বলতেন, ‘আমি কাগজে আলোকার একটি লাইন দেখি, এবং আমি তার অনুসরণ করি আমার ব্রাশ দিয়ে।’ পাখিরা কাজের পুনরাবৃত্ত বিষয় ছিল। শ্রী চিন্ময় মনে করতেন, পাখিরা মানে আত্মা। তিনি কোটি কোটি আত্মা-পাখি তৈরি করেছেন, যা স্বাধীনতার বার্তা বহন করে, তারা আকাশে উড়ে। শ্রী চিন্ময়ের শিল্পকর্ম ও সঙ্গীত আধ্যাত্মীক সত্তার বহুরূপ প্রকাশ। তাঁর বাজানো বাঁশি, হারমোনিয়াম বা পিয়ানো কেবল যন্ত্র নয়, বরং আত্মার কণ্ঠসর। তিনি প্রায়শই র্প্বূ ও পশ্চিমের বাদ্যযন্ত্রের এক অপূর্ব মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তিনি প্রায় ১,৪০,০০০ এরও বেশি বিমূর্ত চিত্রকর্ম এবং ১ কোটি ৬০ লক্ষ (ষোল মিলিয়ন) এর বেশি আত্মার পাখি (Soul Bird) এঁকেছেন।
শ্রী চিন্ময় সমগ্র সৃষ্টিশীলতা এক কেন্দ্রীয় ধারণার দিকে ইঙ্গিত করে। যা মহাজাগতিক ঐক্য। আমি আর তুমি, ভিতর আর বাহির এর পার্থক্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। তিনি বলতেন, ‘when l paint. I feel thst. I am expanding. My consciousness becames one with the universe.’ তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মানুষই ‘Divine Artist.’ জীবনে এসব দার্শনিক-মতবাদ ও সৃজনশীলকর্ম এনে দেয় সুবর্ণ সুযোগ, এবং বিশ্বের এতাবৎ খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সান্নিধ্য ও সাক্ষাৎ পেতেও। তার মধ্যে বিশ্বের এ যাবতকালের সেরা বক্সার মুহাম্মদ আলী ক্লে, বিশ্বের দীর্ঘতম কারানির্যাতিত ও দক্ষিণ আফ্রিকার অসংবাদিত বর্ণবাদ বিরোধী বিপ্লবী নেলসন ম্যান্ডলা, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি প্রফেসর ইব্রাহিম, মার্কিন দৌড়বিদ ও বিশ্ব অলিম্পিক আসরের ৯ বারের স্বর্ণপদ বিজয়ী কার্ল লুইস, গ্রেট ব্রিটেনের রাজবধূ প্রিন্সেস ডায়না, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা, সুফি সাধক বেলায়েত খান, উপমহাদেশের সেরা সেতারবাদক রবিশঙ্কর, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও বর্ণবাদবিরোধী নেতা আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ অন্যতম। বিশ্বের এ সকল কিংবদন্তীতুল্য ব্যক্তিবর্গ, তাঁর এ অনন্য সৃষ্টি ও বিশ্বের শান্তির উদ্যোগে মুগ্ধ হন। তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে নিউইয়র্কে অবস্থান করেন।
শ্রী চিন্ময়ের জন্মভূমি বাংলাদেশ, নিউইয়ার্ক, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ডসহ বিশ্বের একাধিক শহরে ৩ শতাধিক শ্রীচিন্ময় কেন্দ্র রয়েছে। এতসব দৃষ্টান্তমুলক ও গুণমুগ্ধকর সৃজনশীলকর্ম গিনিস বুকর্স অপ ওয়ার্ল্ডে স্থান পায়নি। পাননি তিনিও তাঁর কেন্দ্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। তাহলে তিনি কি বৈরীতার কবলে পড়েছেন? যদি এমনটা হয়, তাহলে বলতে হয় এ সর্বজন স্বীকৃত সৃজনী ও গুণীজনের প্রতি অবিচার করা হয়ছে। তা হলে এসব শিহরণ জাগানো প্রতিষ্ঠান নিরেপক্ষ নয়- নাকি বুঝে ওঠতে পারেনি তাঁর সৃজন কর্মের ভাবার্থ ও বিমূর্তা।
১৯৩১-২০০৭ সালে ২৭ আগস্ট শ্রী চিন্ময় ঘোষের জন্ম। ১৯৪৪ সালে মা যোগমায়া ও বাবা শশী কুমার ঘোষের অকাল মৃত্যুতে পরিবারের ৭ ভাইবোন নিয়ে দক্ষিণ ভারতের পন্ডিচেরীর ঋষিঅরবিন্দ আশ্রমে অবস্থান নেন। সেখানে কঠিন সাধনায় আধ্যত্মিকতায় লব্ধজ্ঞান সাধন করেন এবং পাশাপাশি তাঁর অনবদ্য সৃজনশীল কর্মের প্রদচারণায় কর্দাত্ত পথ মৃষণ হতে থাকে। বিশেষ করে কবিতা, গান, সঙ্গীতচর্চা সহ চিত্রকর্মে হাতেখড়ি হন। অতঃপর পৃথিবী হয় এক অবারিত। (তথ্যসূত্র: শ্রী চিন্ময়ের আলোকিত জীবন-গ্রন্থ, প্রচার হেন্ডবিল ও অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. এন এইচ এম আকবর এর পাঠ করা প্রবন্ধ।)
শান্তিশ্রী ম্যাগ্রাথ: ভরণ্য সাধক শ্রী চিন্ময় ঘোষেরে জন্মভূমি চট্টগ্রামের জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে গত ১১ অক্টোবর হতে ১৮ অক্টবোর পর্যন্ত ৭দিন ব্যাপী শ্রী চিন্ময় ঘোষের সৃজনশীলকর্ম সহ জীবনের নানা দিক নিয়ে হয়ে গেল আচার-অনুষ্ঠান। অবশ্য এ অনুষ্ঠানের মাঝে একদিন চিত্র প্রদর্শনী ও শেষেদিন গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে থাকার সৌভাগ্য হয়। অনুষ্ঠানে শ্রী চিন্ময় ঘোষ টর্চ বিহারা পদকে ভূষিত হন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক অধ্যাপক হরিশংকর জলদাস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের প্রফেসর ড. জিনোবোধি ভিক্ষু ও চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সৈয়দ মোহাম্মদ আয়েস মাবুদ। অনুষ্ঠানে বাঙালি বধু সাজে শাড়ি ও ব্লাউজ পরিহত এক বিদেশিনীকে অতিথি হিসেবে দেখা যায়। তাঁর শারীরিক গঠন ও সক্ষমতা দেখে খোদ সংবর্ধিত অতিথি সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস তাঁর পাশে বসা অর্ধাঙ্গিনীর উদ্দেশ্য বলেন, দেখ ৮১ বছরের বৃদ্ধ নারী কিভাবে ছুটাছুটি করছেন। তাঁর শরীর ও মনের সক্ষমতা কতই স্ট্রং (Storong)। আর আমাদের দেশে এ বয়সের নারীরা নুয়ে পড়ে। এ বিদেশিনী অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্তর করে রেখেছেন। সত্যি তাঁর মধ্যে কোনপ্রকার জড়তা দেখা যায়নি, নির্ভয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠানকে ঘুচিয়ে নিয়েছেম। এ বিদেশিনী জানালেন তার নাম ও স্বমীর নাম গুরুজি নিজে রেখেছেন। তাঁর নাম শান্তিশ্রী ম্যাগ্রাথ। তাঁদের নামসহ প্রায় দেড়শ জনের নাম বাংলায় রেখেছেন গুরুজি।
অবশ্য এ বিদেশিনীর সাথে আমার অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে সাক্ষাৎ হয় এবং নানা বিষয়ে আমাদের বেশকিছুক্ষণ কথোপকথন হয়। সমস্যা হলো ইংরেজিতে আমার তেমন একটা পারমঙ্গতা নেই বললে ভুল হবে না। তারপরও কি থেমে থাকা যায়; আয়োজকদের এক যুবক টাসলেট করে সুযোগ করে দেয়। এতে তবে উভয়জনের কিছুটা সমস্যা হয়। বিশেষ করে ভাষাগত সমস্যা না হলে আরো প্রাণবন্ত ও অন্তর্নিহিত দিকগুলো রেখাপাত হতো। শান্তিশ্রী ম্যাকগ্রাথ একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার। টানা ১০ বছর ধরে আমেরিকাস্থ শ্রী চিন্ময় ঘোষ সেন্টারে কাজ করেছেন। বিশেষ করে শ্রী চিন্ময় ঘোষের প্রকাশিত সকল গ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছেন। তিনি চট্টগ্রামস্থ শ্রী চিন্ময় ঘোষ সেন্টারে ১ বছর সহ ঢাকার সেন্টারে ১০ বছর ধরে যাওয়া-আসার মধ্যে দিয়ে পরিচালক হিসাবে নিয়োজিত রয়েছেন। মুলত তিনি গৃহিণী ছিলেন। একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক- শ্রোতাদের পরিচয় জানছিলেন গুরু শ্রী চিন্ময় ঘোষ। উপস্থিত সকলে একেএকে নিজেদের পরিচয় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার দিচ্ছিলেন। শান্তিশ্রী ম্যাকগ্রেট দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় গৃহিণী দিলে শ্রী চিন্ময় ঘোষ হেঁসে দিলেন এবং বললেন, এ প্রথম তিনি গৃহিণী পরিচয়ের শব্দটি শুনেছেন। এতে শান্তিশ্রী ম্যাকগ্রেট লজ্জা পেলেন। তখন তিনি বিবাহিতা এবং বয়স পঁচিশ। ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন শান্তিশ্রী ম্যাকগ্রাথের স্বামী Tom M Grath (Nttyananda. শান্তিশ্রী ম্যাগ্রাথ স্কটল্যান্ডের Glasgow বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, অনুষ্ঠানটি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছিল। শ্রী চিন্ময় ঘোষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছিলেন। তখম শ্রী চিন্ময় ঘোষকে দেখে তাঁর মনে একধরণের অনুভ‚তি হয় এবং সে বুঝে নিয়েছে তাঁর মধ্যে যে সমস্যায় রয়েছে, তা তিনিই একমাত্র সমাধান দিতে পারবেন! সঙ্গে অনুষ্ঠানে আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক ধারণা জন্মে, এ সাধক পুরুষকে দেখে। তাঁর স্বামী একজন বড় মাফের লেখক ও নাট্যকার। তার লেখা নাটক The Headsman. যেটি সত্য ঘটনার অবলম্বনে রচিত। এটি স্কটল্যান্ডেসহ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বহুবার মঞ্চায়ন হয় এবং স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের টিভিতেও দেখানো হয়েছে। এটি দর্শক জনপ্রিয়তা পাই, এতে করে লেখক হিসেবে স্বামীর সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর স্বামী মারা যান ২০১০ সালের দিকে, তখনো স্বামী ছিলেন বয়সে ষাটোর্ধ । তাঁরা স্বামী ও স্ত্রী শ্রী চিন্ময় ঘোষের অনুসারী-ভক্ত এবং নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন করে আসছেন। এছাড়া কয়েকবার পিস দৌড়েও অংশ নেন। তাদের ৪ কন্যা সন্তান রয়েছে। তাদের নাম যথাক্রমে, pranati. Sonia. Ballabha. Shobana। তারা সবাই বিবাহিতা এবং সকলের সংসার রয়েছে।
শান্তিশ্রী ম্যাকগ্রাথের জন্মভূমি কিংডম অব স্কটল্যান্ড একসময় উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের একটি স্বাধীন দেশ ছিল। এটি ১৭০৭ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এরপর ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে গ্রেট ব্রিটেনের রাজ্য গঠিত। তারপরও তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়, সাংস্কৃতিক এবং পৃথক একটি রাজধানী আছে। এ স্কটল্যান্ডের নাগরিক বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্কে যা বললেন, এদেশের মানুষ সহজ-সরল এবং ভাবনা-চিন্তা যা করে, মাথা থেকে নয় অন্তত থেকে। সর্বশেষ তাঁর ভাবনা ও ইচ্ছে, গুরু শ্রী চিন্ময় ঘোষের নীতি ও আদর্শ ধারণ করা এবং বিশ্বময় শান্তি কামনা করা। গুরু শ্রী চিন্ময় ঘোষ একক কোন ধর্ম বিশ্বাস করতে না, তিনি সর্বধর্ম ও সর্ব মতের বিশ্বাসী ছিলেন।
লেখক : কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক











