সোহেল মো. ফখরুদ-দীন
আমাদের বাংলা সাহিত্য, অনুবাদকর্ম ও শিক্ষায় যে ক’জন মনীষা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথামালা, জীবনপ্রবাহ ও আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরতে নিরবিচারে কাজ করে চলেছেন, তাঁদের অন্যতম শাওয়াল খান। তিনি শুধু একজন লেখক বা অনুবাদক নন, বরং এক আলোকিত পথিকৃৎ যিনি সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ বিশ্লেষণ এবং মানবিক উপলব্ধির মধ্য দিয়ে নির্মাণ করেছেন এক আশ্চর্য পাঠভুবন। সাংবাদিকতা, গবেষণা ও বিশেষত নারী ও শিশুশিক্ষা উন্নয়নে তাঁর নিরলস প্রয়াস এদেশের শিক্ষানীতির বাস্তবভিত্তিক পুনর্গঠনে একটি সাহসী ভূমিকা রাখছে।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন: আত্মপ্রকাশের বীজরোপণ: শাওয়াল খানের জন্ম ১৯৬৬ সালের ২০ ফেব্রæয়ারি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায়। সমুদ্র, পাহাড় আর সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়া এই জনপদ থেকেই জন্ম নিয়েছে তাঁর চিন্তার গভীরতা ও সমাজসচেতন মনন। শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় স্থানীয় বিদ্যালয়ে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এই শিক্ষার ভিত্তিতেই তিনি যুক্ত হন সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির গভীর অন্বেষণে।
সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ : নাগরিক টানাপোড়েনের গল্পকার: লেখালেখিতে তাঁর সক্রিয়তা শুরু ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে। প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘অক্টোপাস’ (বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প, ১৯৯৬) তাঁকে সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র কণ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। তাঁর গল্পে উঠে এসেছে নাগরিক জীবনের সংকট, আত্মপরিচয়ের দোলাচল, আধুনিক মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সামাজিক মূল্যবোধের বিবর্তন। ভাষার সাবলীলতা, মনস্তত্তে¡র বিশ্লেষণ এবং পাঠকের সঙ্গে সংলাপের দক্ষতা তাঁকে একজন শক্তিশালী সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত করেছে।
অনুবাদকর্ম: ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন: শাওয়াল খানের অনুবাদসাহিত্য বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য এক অনন্য ভান্ডার তৈরি করেছে। তিনি কেবল শব্দ অনুবাদ করেননি, বরং সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইতিহাসের স্পন্দনকে ভাষান্তরে রূপ দিয়েছেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থ ‘রাঙাডোরা’ (মূল: The Scarlet Thread: An Indian Woman Speaks) কেবল অনুবাদ নয়, বরং ভারতীয় উপমহাদেশের নারীমুক্তি ও সমাজ রূপান্তরের এক সামাজিক দলিল। এই গ্রন্থ সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণ বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য মূল্যবান সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক স্থরের বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি উইগার মুসলিমদের লোককথা অবলম্বনে ‘আফেন্দি নাসিরুদ্দিনের বুলিগল্প’ নামে একটি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশের পথে এনেছেন, যা সংখ্যালঘু মুসলিমদের কল্পলোক ও প্রতীকী ভাষা বাংলায় তুলে আনার একটি সাহসী প্রয়াস। এ কাজ বাংলা সাহিত্যকে বহুজাতিক, বহুসাংস্কৃতিক আলোচনার অংশীদার করেছে।
শিক্ষা গবেষণা : প্রান্তিকতার ভাষ্যকার শাওয়াল খান এমন একজন গবেষক যিনি ‘উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা’ বা ‘non-formal education’ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে। নারী ও শিশুশিক্ষা, আজীবন শিক্ষা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার চাহিদা ও প্রাপ্তির ব্যবধান নিয়ে তাঁর গবেষণা কাজ বাংলাদেশে একটি নীতিগত দৃষ্টিকোণ নির্মাণে ভূমিকা রাখছে। তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ ‘শিক্ষা জগৎ’ এবং ‘শিক্ষার চাহিদা ও শিক্ষার যোগান’ । এই গ্রন্থগুলো শুধু একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ দিয়ে আমাদের শিক্ষা কাঠামোর দুর্বলতা, সম্ভাবনা ও করণীয় নিরূপণ করে।
সাংবাদিকতা : প্রান্তিকতার মুখপত্র – শাওয়াল খান একজন নিবেদিত সাংবাদিক। দৈনিক নয়া দিগন্ত-এ নিয়মিত কলাম লেখার মাধ্যমে তিনি শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন। তাঁর লেখাগুলোতে রয়েছে তথ্যনিষ্ঠতা, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এক প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিশ্লেষণ। বিশেষ করে তাঁর আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত গবেষণাপত্র “বর্তমান বিশ্ব ও ডিজিটাল সাক্ষরতার গুরুত্ব” বর্তমান সময়ে ডিজিটাল ব্যবস্থার ভিত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
শিশু ও নারীশিক্ষা : সমাজ বদলের মূল শক্তি- শিশু ও নারীশিক্ষার ওপর শাওয়াল খানের বিশেষ মনোনিবেশ এই দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ যে, সমাজে টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশুর সৃজনশীল বিকাশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তাঁর মতে, “একজন শিক্ষিত নারী মানে একটি শিক্ষিত সমাজের সম্ভাবনা।” তাঁর রচনায় শিশুদের কল্পনার জগৎ, নারীর আত্মপ্রকাশ ও স্বাধীনচেতা ভূমিকার চিত্রায়ণ পাঠককে ভাবায়, অনুপ্রাণিত করে।
বিশ্বরাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ভাবনা : শাওয়াল খানের চিন্তাজগৎ স্থানীয় সীমারেখা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিস্তৃত। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বিশ্ব রাজনীতি তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে একটি বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে। অনূদিত গ্রন্থ “মার্কিন সাম্রাজ্য পতনের পরে” এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের বিখ্যাত গ্রিম ভাইদের রচনাবলী এর অনুবাদ তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন। বিশ্বায়নের যুগে ‘ব্রেইন চাইল্ড’ বা জ্ঞানের ব্যবসায়িকীকরণ প্রসঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাঠককে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: জ্ঞানের আলোকমালায় ভাস্বর: শাওয়াল খানের রচনার পরিসর বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময়। তাঁর প্রকাশিত ও আসন্ন বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
অক্টোপাস (গল্পগ্রন্থ), রাঙাডোরা (অনুবাদ),
আফেন্দি নাসিরুদ্দিনের বুলিগল্প (অনুবাদ),
শিক্ষার দৃষ্টান্ত ও শিক্ষানীতি, শিক্ষা জগৎ
শিক্ষার চাহিদা ও শিক্ষার যোগান, বর্ণের ছড়া ও বর্ণপরিচয়, মার্কিন সাম্রাজ্য পতনের পরে (অনুবাদ) এই বইগুলো কেবল পাঠককে জ্ঞান ও ভাবনার খোরাক দেয় না, বরং সমাজ পরিবর্তনের এক অন্তর্মুখী শক্তি হিসেবে কাজ করে।
সমাজে ভূমিকা ও ভবিষ্যতের পথচলা: শাওয়াল খান আজকের সময়ে এক অনন্য মনীষা। তাঁর কাজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, পরিবর্তন আসবে তখনই, যখন কেউ নিরব থেকে সমাজের ভেতরে আলো ছড়িয়ে যাবে। তাঁর লেখনী শুধু প্রজ্ঞাবান পাঠকদের নয়, সাধারণ মানুষের জীবনবোধ ও স্বপ্নকেও ছুঁয়ে যায়।
শাওয়াল খানের কর্মজীবন আমাদের দেখায়, একজন সাহিত্যিক কিভাবে গবেষক হতে পারেন, একজন অনুবাদক কিভাবে শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেন এবং একজন শিক্ষাবিদ কিভাবে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর হতে পারেন। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমুদ্র নগরী কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে উঠে আসা এই আলোকিত ব্যক্তি, শাওয়াল খান, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দিগন্ত প্রসারিত করেছেন নিজের সৃজনশীলতা ও দায়বদ্ধতার মাধ্যমে। তিনি সমাজের আলোচনার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর কথা বলেন, তিনি অনুবাদের মাধ্যমে সংস্কৃতির সেতুবন্ধন গড়ে তোলেন, এবং শিক্ষার মাধ্যমে জাতি গঠনের ভিত মজবুত করেন। তিনি সুস্থ ও নিরাপদে থাকুক।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস চর্চা পরিষদ ও
সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র ( সিএইচআরসি )