শহরের শিল্প-চেতনার আশ্রয়স্থল

1

মিখাইল মোহাম্মদ রফিক

চট্টগ্রাম শহরের শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার যতগুলো কেন্দ্র রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হৃদস্পর্শী ও ঐতিহ্যবাহী নাম ‘চারুকলা ইনস্টিটিউট’। নগরের বাদশা মিয়া সড়কে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু একটি একাডেমিক শিক্ষাকেন্দ্র নয়, এটি হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের শিল্প-মনস্ক মানুষদের কাছে এক মানসিক ঠিকানাÑ একটি সাংস্কৃতিক অহংকার। একসময় এটি পরিচিত ছিল সরকারি চারুকলা কলেজ নামে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এটি স্থান পেয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, এবং এখন ‘চারুকলা ইনস্টিটিউট’ নামে পরিচিত। তবে নাম পরিবর্তিত হলেও চেতনা বদলায়নি। বরং সময়ের আবর্তে সেই চেতনা হয়েছে আরও গাঢ়, আরও ব্যাপ্ত।
এই প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্নেই জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, শিল্পী রসিদ চৌধুরী। তাঁর দূরদৃষ্টি, শিল্পমুগ্ধতা ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ববোধ থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। তাঁর স্বপ্নে ও শ্রমে জন্ম নেয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে কেবল আঁকা হয় না, বরং গড়ে ওঠে একেকটি শিল্পমনস্ক প্রজন্ম।
শুধু একজন রসিদ চৌধুরী নন, বহু মননশীল ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের গঠনে অবদান রেখেছেন। মেধা, পরিশ্রম এবং কখনো কখনো ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে তাঁরা এ প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে সোলস, তির্যক, অরিন্দমের মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনÑ যা শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসেও স্থান করে নিয়েছে।
চারুকলা ইনস্টিটিউটের দেয়াল জুড়ে কেবল রঙ নয়, জড়িয়ে আছে সময়ের গল্প, আন্দোলনের ভাষা, প্রতিবাদের রেখা। এখানকার আর্ট গ্যালারি ‘রসিদ চৌধুরী আর্ট গ্যালারি’ কেবল শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জায়গা নয়; এটি শিল্পবোধ, স্বদেশচেতনা এবং সৃজনশীলতার এক সম্মিলিত অনুরণন। দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের চিত্রকর্ম এখানে প্রদর্শিত হয়েছে, শিল্পীরা পেয়েছেন মূল্যায়ন ও দর্শকদের সাড়া।
প্রতিষ্ঠানটির পাঠাগার হয়ে উঠেছে নির্লোভ পাঠকদের আশ্রয়। উন্মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে কবিতা-পাঠ, গান, নাটক ‘প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ হোক কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী’ চারুকলার চৌহদ্দিতে সবই পেয়েছে প্রাণ। শিল্প এখানে নিছক শিক্ষা নয়, বরং এক ধরণের সামাজিক দায়বদ্ধতা, একটি জীবনদর্শন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শিল্পচর্চার এ মহত স্থানটির অস্তিত্ব মাঝেমধ্যে নানা প্রশাসনিক ও অব্যবস্থাপনার ছায়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এখানে অনাকাক্সিক্ষত কার্যক্রম, অশিল্পসুলভ কর্মকান্ড, এমনকি বাণিজ্যিকীকরণের চাপও পরিলক্ষিত হয়েছে কিছু সময়। শহরের শিল্পমনস্ক নাগরিকরা তাই বারবার উচ্চারণ করেছেন- চারুকলা ইনস্টিটিউট শিল্প-সংস্কৃতির ঘর। এখানে এর বাইরে কিছুই কাম্য নয়।
এমন একটি প্রতিষ্ঠান শুধু সংরক্ষণ করলেই চলবে না, বরং এটিকে হতে হবে নগরের সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কৌশলগত অংশ। সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় একে করে তুলতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পচর্চার এক অন্যতম কেন্দ্রে। শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যজন, সংগীতশিল্পীÑ সকলের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে এ প্রতিষ্ঠানকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে। একটি শহরের চেহারা কেবল তার ভবন, যানবাহন বা অর্থনীতিতে নয়; সেই শহর কতটা শিল্পচর্চা করে, সংস্কৃতিকে ধারণ করে, তা দিয়েও নির্ধারিত হয়। সে বিচারে চট্টগ্রামের চারুকলা ইনস্টিটিউট নিঃসন্দেহে এই নগরের হৃদয়ে অবস্থান করছে।
আমরা আশা করি, শিল্প-সংস্কৃতির এই পীঠস্থান আগামী দিনগুলোতেও একইভাবে নগরবাসীর ভাবনার কেন্দ্রে থাকবেÑ সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নাটক ও মানবিক বোধে পরিপূর্ণ একটি পরিসর হয়ে।

লেখক : নাট্যকর্মী, চিত্রশিল্পী ও সাংবাদিক