শস্যভান্ডারে সোনালী ধানে নবান্নের আনন্দ

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাঙালি কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত গান ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’র একাংশে লিখেছেন, ‘এত স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়, কোথায় এমন হরিত ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে, এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে’। কবির গীতিকথার মতোই গ্রামবাংলার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে শস্যভান্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে। নিশ্চিন্তাপুর পাহাড়ের পাদদেশে নীল আকাশের নিচে দোল খাচ্ছে আমনের সোনালী ধান। সোনালী ধানের ঝিলিকে কৃষকের মুখেও হাসি ফুটেছে। গুমাই বিলে ধান কাটার ধুমে কৃষকের ঘরে এখন নবান্নের আনন্দ। আমন মৌসুমে এবার গুমাই বিলে ৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার মেট্রিক টন।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস পূর্বদেশকে বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ধান কাটা শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। শস্যভান্ডার গুমাই বিলের চাষাবাদকৃত জমির আয়তন ৩ হাজার ২০০ হেক্টর। গত বছর গুমাই বিলে আমন মৌসুমে আবাদ হয়েছে ১৬ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন ধান। এ বছর আমরা আশা করছি ১৭ হাজার মেট্রিক টন ধান হবে। কিছু উচ্চফলনশীল জাতের চাষাবাদ হওয়ায় কৃষকরা উদ্ভুদ্ধ হয়েছে। গুমাই বিলে চাষাবাদ হওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত হচ্ছে ব্রিধান-৫১। তবে প্রথমবারের মতো চাষাবাদ হওয়া ব্রিধান-১০৩ জাতের অভাবনীয় ফলনে কৃষকরা দারুণ খুশি। এই জাতের ধান পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র দুই হেক্টরের বেশি জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। এতেই প্রতি হেক্টরে ৬.৪ মেট্রিক টন ধানের ফলন হয়েছে। যেখানে অন্য ধানের প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ৫.৪ মেট্রিক টন। আগামি বছর এ জাতের ধান উৎপাদনে কৃষকদের উদ্ভুদ্ধ করা হবে’।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়া অংশে বাম পাশের বিশাল এলাকার কৃষিজমি গুমাই বিল নামে পরিচিত। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিলগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর, চন্দ্রঘোনা, হোসনাবাদ, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আছে গুমাই বিল। এ বিলের বিভিন্ন অংশে উইটল্যা খাল, হরিণ্যাখালসহ পাঁচটি খালের প্রবাহ বয়ে গেছে। এসব খালের জোয়ার ভাটার পানিতেই বেঁচে আছে গুমাই বিল। প্রতি বছর এ বিলে ধান কাটার উৎসবে মেতে ওঠে প্রায় সাত হাজার কৃষক। সাতকানিয়া, বাঁশখালী, চকরিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কৃষি শ্রমিকেরা ধান কাটার জন্য এসে জড়ো হয় গুমাই বিলে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কথায় আছে, ‘আঁতত কাঁচি, কোঁরত দা, ভাত হাইতু চাইলি রইন্যা যা’। শ্রমজীবী কৃষকদের ভাতের ভান্ডার হচ্ছে এই গুমাই বিল। জনশ্রুতি আছে- গুমাই বিলের ধানে বাংলাদেশের আড়াই দিনের খাদ্য সরবরাহ করা হয়।
গত শুক্রবার সরেজমিনে গুমাইবিল ঘুরে দেখা যায়, একের পর একর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধান আর ধান। আমন কাটার মৌসুম হওয়ায় কৃষকের ব্যস্ততা বেড়েছে। যেখানেই সোনালী ধান দোল খাচ্ছে সেখানেই কাস্তে হাতে ধান কাটতে দেখা গেছে কৃষকদের। জমির আশেপাশে কৃষি শ্রমিকদের আনাগোনাও বেড়েছে বেশ। কাঁধে করে ভারে ভারে ধান তোলা হচ্ছে। গুনগুন গানে কন্ঠ মিলিয়ে কাস্তে ফেলছে ধানের গোছে। বিলের আইলে কিংবা রাস্তার ধারে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে ধান। নবান্নের আবহে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছেন কৃষকরা।
মরিয়মনগর এলাকার কৃষক মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘এ বছর ভালো ধান হয়েছে। এখনো পুরোপুরি বাইরের এলাকা থেকে শ্রমিক আসেনি। যে কারণে স্থানীয় শ্রমিক দিয়েই ফলন তোলা হচ্ছে। ভালো ফলন হলেও অনেক কৃষকের ফসল তোলা নিয়ে টেনশন আছে। শ্রমিক সংকট যেমন আছে তেমনি শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। কৃষক বেশি আসলে মজুরি কিছুটা কমে’।
কাটা বটতল এলাকার কৃষক সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘ব্রিধান-৫১ ও ৫২ চাষ করে ভালো ফলন হয়েছে। আগামি সপ্তাহের মধ্যে ধান তোলা হবে। ধান তোলা নিয়ে আমাদের এখন ব্যস্ততা বেড়েছে। প্রতি বছর এই মৌসুম আসলে গুমাই বিলের কৃষকদের মধ্যে আনন্দ থাকে। এবার ফলন বেশি হওয়ায় আনন্দ একটু বেড়েছে’।
উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, রাঙ্গুনিয়ায় ১৫ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। এরমধ্যে গুমাইবিলে চাষাবাদ হয় ৩ হাজার ২০০ হেক্টর। গুমাইবিলে কৃষকদের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত হচ্ছে ব্রিধান-৫১। এ ধানের বিশেষত্ব হচ্ছে পানির মধ্যে কোনো সমস্যা ছাড়াই ৮-১০ দিন ডুবে থাকতে পারে। পানি জমে থাকায় গুমাইবিলে ব্রিধান-৫১ এবং ব্রিধান-৫২ কৃষকরা খুব চাষ করে। এছাড়াও নতুন কিছু জাত ব্রিধান-৯১, ব্রিধান-৪৯, ব্রিধান-৪৮, ব্রিধান-৭৫ এর চাষের পরিমাণও বাড়ছে।