সুব্রত
‘পরিণীতা’ উপন্যাসটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রোমান্টিক উপন্যাসই বলা চলে। শরৎচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাসের নারী চরিত্রের মতোই ললিতার চরিত্রের দৃঢ়তা পাঠকের মন কেড়ে নেয়। অন্যদিকে দুই পুরুষ চরিত্র শেখর ও গিরীন্দ্রের ক্ষেত্রে পাঠক দেখে একে অপরের পুরোই বিপরীত রূপ। এক পুরুষ যেখানে ছিল ভীতু এবং দুর্বলচেতা, অপরদিকে আরেক পুরুষ ছিল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও স্বার্থত্যাগী। এই উপন্যাসে তৎকালীন সমাজের শ্রেণি-ধর্ম-জাত বৈষম্যের চিত্রটিও ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।
ষাট টাকা বেতনের ব্যাংকের কেরানী গুরুচরণের অভাবের সংসারে পঞ্চম কন্যাসন্তানের আগমন ঘটে। স্ত্রীসহ সাতজন সদস্য ছাড়াও তার উপর রয়েছে পিতৃ-মাতৃহীন ভাগ্নি ললিতার দায়িত্ব। ললিতার মামা তাকে বড্ড ভালোবাসেন, নিজের মেয়েদের তুলনায় যেন তা ঢের বেশি। শুধু মামার কাছেই নয়, তেরো বছর বয়সী শ্যামবর্ণের, ঘরের কাজে নিপুণা এবং মিষ্টি স্বভাবের এই মেয়েটি সকলেরই বেশ আদরের যার ব্যতিক্রম প্রতিবেশী গিন্নী ভুবনেশ্বরীও নন। ললিতাই শুধুমাত্র যে ভুবনেশ্বরীকে মা বলে সম্বোধন করতো তা নয়, ভুবনেশ্বরীও প্রকৃতপক্ষে তাকে সন্তানসম মনে করতেন। ভুবনেশ্বরীর ছোটছেলে শেখরনাথের কাছে ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়া শেখে বলে ললিতার এ বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল। অন্যদিকে মেজোমেয়ের বিয়ের সময় গুরুচরণ শেখরের পিতা নবীন রায়ের কাছে নিজের বাড়িটি বন্ধক রেখেছিলেন। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও তার সুদ পরিশোধ করা হয়নি বলে মনে মনে গুরুচরণের বাড়িটি দখলের ইচ্ছা পোষণ করতেন নবীন।
গুরুচরণ হঠাৎ একদিন শেখরের কাছে ললিতার বিয়ের জন্য ভালো পাত্রের সন্ধান দিতে বলেন। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সী, পেশায় এটর্নি শেখর সেদিন তার কথার তেমন গুরুত্ব দেয় না। পাড়ার লোকের কাছে শেখর-ললিতার সম্পর্ক শ্রদ্ধা ও স্নেহের, ললিতাও শেখরকে দাদা বলেই সম্বোধন করে। কিন্তু শেখরের মনে যে ললিতাকে নিয়ে এক দুর্বলতার সৃষ্টি হয়েছিল তা হয়তো ললিতা নিজেও জানতো না। ললিতা শেখরের ঘর গুছিয়ে রাখতো, তার ঘরে খাবার দিয়ে আসতো, এমনকি শেখর তার আলমারির চাবি মাঝেমধ্যে ললিতার কাছে দিয়ে যেতো যাতে সে প্রয়োজনে টাকাপয়সা নিতে পারে।
ললিতা শেখরকে বেশ মান্য করে। শেখরের পছন্দ নয় বলে ললিতা তার মামাতো বোন আন্নাকালী, সই চারুবালা ও চারুর মামা গিরীনবাবুর সাথে থিয়েটার দেখতে যায় না। এমনকি শেখর অপছন্দ করে বলে সে চা খায় না, চারুর মা মনোরমার অনুরোধে চারুদের বাড়িতে তাস খেলতে যেতেও অনীহা প্রকাশ করে। চারুর মামা বি.এ. পড়ুয়া গিরীন পৈত্রিকসূত্রে বেশ সচ্ছল। ধীরে ধীরে গিরীনও ললিতাকে পছন্দ করতে শুরু করে। ঘটনাক্রমে গিরীনের অর্থ-সহায়তায় গুরুচরণ তার সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে বাড়ির দলিল নবীনবাবুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হন। একদিন এক জ্যোৎস্নারাতে গোপনে শেখর-ললিতার মালাবদল হয়ে যায়। এর প্রভাবে কিশোরী ললিতা অনেকটাই পরিণত হয়ে ওঠে । ললিতা নিজেকে বিবাহিতা মনে করতে শুরু করে, শেখরও যেন একটি মালা পরিয়েই ললিতাকে নিজের করে নিয়েছে এমন মনে করতে থাকে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার পরদিনই শেখর তার মাকে নিয়ে পশ্চিমের দেশে যায় হাওয়া বদল করাতে। প্রবাসকালে তিনমাস পর একদিন তার কাছে খবর আসে যে ললিতার মামা তথা অভিভাবক গুরুচরণ হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম হয়েছেন। এ খবরটি শুনে মাকে নিয়ে শেখর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসলেও পিতা-মাতা ললিতাকে মেনে নেবে না এই ভয়ে কিছু বলতে পারে না। প্রথমদিকে, ললিতার মাধ্যমে সব জানাজানি হয়ে যায় কি না সে ব্যাপারে শেখর চিন্তিত থাকলেও ললিতা তেমন কিছুই করে না।
মুঙ্গেরেই গুরুচরণ অসুখে প্রাণত্যাগ করেন, গিরীন সবসময়ই গুরুচরণের পরিবারের পাশে ছিল। কিছুদিনের মধ্যে শেখরের পিতা নবীন রায়ও মারা যান। বছরখানেক পর শেখরের বিয়ের কথা ওঠে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বছর পার হয়ে যাওয়ায় সে একরকম ললিতার আশা ছেড়ে দিয়েছিল বলে বিয়েতে অমত করেনি। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসার হঠাৎ ক’দিন আগে খবর আসে ললিতারা বাড়ি বেচতে ফিরে এসেছে। গুরুচরণের বিধবা স্ত্রীর সাথে দেখা করতে এসে ‘পরস্ত্রী’ ললিতাকে দেখে যেন ঘৃণায় শেখরের সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে। এমনকি ললিতা কথা বলতে চাইলেও শেখর তাকে উপেক্ষা করে। তারপর একদিন ওই বাড়ির জামাই গিরীন বাড়ি বিক্রির কথা বলতে শেখরদের বাড়িতে এলে আলোচনাক্রমে সে ললিতাকে ‘সেজদি’ বলে সম্বোধন করায় শেখর হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।