কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
শব্দদূষণ বাড়ছে। বাড়ছে মানসিক যন্ত্রণা! বাড়ছে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও। শব্দদূষণ মানুষের শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অসুস্থতা বেড়ে যায়। বাসাবাড়িতে অবস্থানকারী সুস্থ মানুষ ছাড়াও রোগী, বৃদ্ধ, শিশুসহ সবাই শব্দদূষণের শিকার! কী দিন কী রাত শব্দদূষণে বিষিয়ে উঠেছে জনজীবন। নানা অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র, সাউন্ড সিস্টেম ডেকসেট, সাউন্ডবক্সসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থেকেও সৃষ্ট শব্দ বিরক্তির উদ্রেক করে। এসব কারণে দূরের লোকালয়ের চেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে পাশের বাড়ির মানুষজন। দিনের চেয়ে রাতের শব্দদূষণ মানুষকে কষ্ট দেয় বেশি।
এভাবে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে শব্দদূষণ।
শব্দদূষণ মানুষের স্বাভাবিকতা কেড়ে নিচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে স্থিরতা, সুস্থতা। কখন এই শব্দদূষণ বন্ধ হবে তা কারো জানা নেই। শব্দদূষণ সহনীয় মাত্রায় না আসলে বা বন্ধ করার ব্যবস্থা না নিলে মানুষের দেহের উপর তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে যা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
বেশকিছুদিন আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণাগারের চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থান নিয়ে করা একটি জরিপ থেকে জানা যায়: নগরীর ৩০টি স্পটে শব্দের মাত্রা পরীক্ষা করে ‘নীরব এলাকা’ শ্রেণিভুক্ত ১৪টি স্পটে শব্দের মাত্রা পওয়া গেছে ৬৭ দশমিক ৬ থেকে ৮০ দশমিক ৫ ডেসিবল পর্যন্ত। এ জরিপে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ গেইট এবং একে খান রোডের আল-আমিন হাসপাতালের সামনে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৯ দশমিক ৫ ডেসিবল। আন্দরকিল্লা জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল এলাকায় ৭৫ দশমিক ৫, পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হাসাপাতাল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিকের কাছে ৭৬ দশমিক ৫ এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে পাওয়া গেছে ৬৭ দশমিক ৬ ডেসিবল।
অথচ শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী এসব এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৪৫ ডেসিবল। চিকিৎসকরা বলেছেন এ ধরনের শব্দ দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি।
এছাড়াও কলকারখানার যন্ত্রপাতির শব্দ, যানবাহনের হর্নের শব্দ, বিমান উড্ডয়ন-অবতরণের সময়ে উচ্চ শব্দ, মাইকের শব্দ, গান-বাজনা, সভা- সমাবেশের বক্তৃতাসহ নানা কারণে শব্দদূষণ ঘটছে। যানবাহনের শব্দে সড়কের পাশে থাকা হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে রাস্তা-ঘাটে চলা দায়। মানুষ শব্দদূষণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে শব্দ নিয়ন্ত্রণের আইন আছে কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। রাত মানুষের ঘুমের জন্য একটি উত্তম সময়। এ সময় প্রায় সব মানুষ তাদের কাজকর্ম শেষে বাড়ি ফেরে। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে মানুষ রাতে ঘুমায়। দিনের পাশাপাশি রাতের এই সময়টুকুও হাতছাড়া হয়ে যায়। জেগে থাকতে হয় রাত অবধি। সূর্যাস্ত থেকে ক্ষেত্রবিশেষে সূর্যোদয় পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানের উচ্চ শব্দ অব্যাহত থাকে। এ ধরনের শব্দ উৎপত্তিস্থল থেকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং রাতের নিস্তব্ধতায় এর ব্যাপকতা আরও গভীরভাবে অনুভূত হয়। ফলে মানুষের সুনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে এবং দেহ ও মনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। কি নগর, কি গ্রাম সর্বত্রই যেন প্রতিযোগিতা দিয়ে শব্দদূষণ বাড়ছে। এ নিয়ে কারো কোন জোরালো ভূমিকাও চোখে পড়েনি কোন সময়। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ চান সাধারণ মানুষ। বিহিত চান এর।
হ্যাঁ, নিঃশব্দে তো আর সব কাজ করা সম্ভব নয়। তাই বলে দিনে-রাতে অনর্থক শব্দদূষণ ঘটানোর কোন মানে হয়না। সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলে কোন কাজ এমনিতে উচিত নয়। দিনের বেলা শব্দদূষণের মাত্রা বেঁধে দেওয়া এবং রাতের বেলা শব্দদূষণ বন্ধ কিংবা নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা অপরিহার্য বলে মনে করি।
পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশে নেহায়েত প্রয়োজন ব্যতীত গাড়ীর হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য। সেখানে উন্মুক্ত স্থানে সভা, সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত মাইকে শব্দ সর্বোচ্চ কত ডেসিবল পর্যন্ত হবে এবং কত সময় অবধি চলতে পারবে তা আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত।
একটা পরীক্ষায় দেখা গেছে উচ্চ শব্দযুক্ত পরিবেশে যারা বসবাস করে বা কাজ করে তাদের শ্রবণ শক্তি দশ বছরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক হ্রাস পায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এর মতে সাধারণত ৬০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে ফেলতে পারে।
শব্দের সহনীয় মাত্রা- শয়নকক্ষে ২৫ডিবি, বসবাস ও খাবার ঘরে ৪০ডিবি, রেস্তোরাঁয় ৪০-৬০ ডিবি, রাত্রিকালীন ৪৫ ডিবি। যখন এই শব্দসীমা অতিক্রম করে তখনই শব্দদূষণ ঘটে।
বিশ্রাম ও ঘুম না হলে কোন মানুষই সুস্থতা বোধ করেনা। মানুষের প্রতিটা অঙ্গই অন্য অঙ্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত। রাতের শব্দদূষণ সেই সুস্থতাটা থাকছেনা। শরীরের সংবেদী অঙ্গ কান যখন উচ্চ শব্দ নিতে পারেনা তখন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যাঘাত ঘটাটাই স্বাভাবিক। এরফলে অসুস্থতা আর অস্বস্তি দুটোই বেড়ে যায়। তাছাড়া, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও রাতে দীর্ঘসময় জেগে থাকার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ রাতে বেশিক্ষণ জেগে থাকেনা। তারা রাতে দ্রæত ঘুমায় আর ভোরেই কাজে যায়। শরীর ও মন সুস্থ রাখতে এই নিয়ম মেনে চলা উচিত আমাদেরও।
শব্দূষণ থেকে রেহাই পেতে আইন কার্যকরের পাশাপাশি কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়:
পরিবহন সেক্টরের শব্দ নিয়ন্ত্রণ, সঠিক নগর পরিকল্পনা-জোনিং কোডের ব্যবহার, রাস্তার শব্দ নিয়ন্ত্রণ, শব্দ-হ্রাসকারী স্থাপত্য নকশা ও বিমানের শব্দ কমানো হলো কিছু শব্দ প্রশমন ব্যবস্থা। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট সংস্থার ব্যবস্থা নিতে হবে।
শব্দদূষণ কমানোর জন্য একটি সাশ্রয়ী টিপস হল ইয়ারপ্লাগ পরা। আশপাশের পরিবেশ থেকে শব্দের পরিমাণ কমাতে এগুলো কাজের জায়গায় ও ঘুমানোর সময় পরিধান করতে পারেন। এটি ব্যবহারে স্বাস্থ্যকর ঘুম ও কানের পর্দার ক্ষতি প্রতিরোধ হবে।
যেসব শিল্প কারখানা তাদের যন্ত্রপাতি থেকে প্রচুর শব্দ উৎপন্ন করে, তারা উচ্চ শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি কমাতে শব্দরোধী উপকরণ ব্যবহার করতে পারেন।
এমনকি বাড়িতেও সাউন্ডপ্রুফিং উপকরণগুলো ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে ডবল-পেন উইন্ডো শব্দদূষণ প্রতিরোধে দারুণ কার্যকরী।
আপনার বাড়ির আশপাশে রাস্তা, যানজট কিংবা অতিরিক্ত গাড়ি চলাচল করলে জানালা বন্ধ রাখুন। ডবল-পেন উইন্ডো বা ডোর হলে আরও বেশি উপকৃত হবেন।
শিল্প ও নির্মাণ শ্রমিকদের শব্দদূষণের ক্ষতি কমাতে বাধ্যতামূলক হেডফোন ব্যবহারের ব্যবস্থা করা উচিত কর্তৃপক্ষের। এ ধরনের হেডফোন অবাঞ্চিত শব্দ ফিল্টার করে ও কানে পৌঁছাতে বাধা দেয়।
কম্পন ও শক্তিশালী শব্দ তরঙ্গ কমানোর একটি সহজ উপায় হলো বাড়ি বা অফিসের চারপাশে গাছ লাগানো। এক্ষেত্রে শব্দদূষণ একটু হলেও কমবে ও আপনার শারীরিক ক্ষতি কমাবে-(সূত্র: কনজার্ভ এনার্জি ফিউচার)
শব্দদূষণ একটি সামাজিক সমস্যা এবং এ ধরনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন ও তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। সাধারণ জনমানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ, বিশ্রাম-নিদ্রা নিশ্চিত করতে উচ্চ শব্দ হতে পরিত্রাণ আবশ্যক। এ ব্যাপারে সকল সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বাড়াতে হবে জনসচেতনতা। তাহলেই কেবল শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট