“শতাব্দীর প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ড হলো নির্বাপিত”

34

খোরশেদ মুকুল

সমালোচনা সাহিত্যে যে ক’জন লেখক নিষ্ঠা ও সততার সাথে আত্মনিয়োগ করে অসামান্য অবদান রেখেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ তাদের মধ্যে অন্যতম। বহুমাত্রিক কিংবা সব্যসাচী লেখক হিসেবে তিনি গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, নাটক, জীবনীসহ লিখেছেন প্রায় দেড় শতাধিক গ্রন্থ। জীবনের অনেকটা অংশ কাটিয়েছেন সম্পাদনার কাজে। স¤পাদনাও করেছেন প্রায় শতাধিক গ্রন্থ। পরিশ্রমী এই লেখক গবেষণা ও নিরীক্ষণধর্মী কাজে সারাজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মননশীল সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অবক্ষয়ী আধুনিকতার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসা ঐতিহ্য সচেতন নান্দনিক অভিযাত্রী তিনি।
মানুষের বোধের পরিবর্তন হয়। বহুধা বাঁকবদল হয়ে নির্দিষ্ট এক জায়গায় গিয়ে থিতু হয়, যেখানে জীবনের অর্থ খুঁজে পায়। স্বার্থকতার সমীকরণ মিলে। সফল পথের সন্ধান পায়। আবদুল মান্নান সৈয়দের জীবনে-মননে-শিল্পেও বহুধা বাঁকবদল ঘটেছে। একসময় তিনি মনে করতেন, জীবন কিছু না; শিল্পই আসল। শিল্পই বড়ো; জীবন নয়। কিন্তু পরে তিনি সে মত থেকে সলজ্জভাবে সরে এসেছেন এবং সে-কথা বারে-বারে, বড় স্বরে উচ্চারণ করেছেন। “তরুণ লেখকের প্রতি” শিরোনামে তিনি কোনো এক তরুণ লেখককে দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেন, “ছিল একটা সময় যখন আমি মনে করতাম, জীবনের চেয়ে শিল্প বড়ো। আজ বুঝেছি, তা কত বড় ভুল। জীবনের কাছে শিল্প কিছু নয়। জীবনের বিস্ময়ের আর উৎসারণের শেষ নেই। শিল্প জীবনের কাছে সূর্যের কাছে মাটির প্রদীপের মতো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, শিল্পকে অশ্রদ্ধা করবো।” (দরোজার পর দরোজা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা, ১৯৯১।) তাঁর কবিতার পরিভ্রমণ স্থিতিপ্রজ্ঞ হয়েছে সকল প্রশংসা তাঁর কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে।
“সকল প্রশংসা তাঁর” কাব্যগ্রন্থটি সম্পূর্ণ সনেটে লেখা হয়েছে। পৃথক পৃথক শিরোনামে এখানে ৩২টি সনেট রয়েছে। উৎসর্গসহ ৩৩টি। এ-কাব্যগ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত ১৯৯৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। পুরোপুরি আধ্যাত্মিক আবহে রচিত হয়েছে এই গ্রন্থটি। বিশ্বাসী নান্দনিকতার অপূর্ব প্রকাশ এখানে দেখতে পাওয়া যায়। গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে অনেকেই ভড়কে যায়। নানা প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হয় কবিকে। বিষয়বস্তুর বিচারে সেটিকে তথাকথিত মৌলবাদী (?) আখ্যা দিলেও শিল্পগুণ বিচারে কেউ দ্বিমত করার সাহস দেখায়নি। কবির পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতে শামসুর রাহমান, আবুল হোসেনসহ অনেকেই সেটা দ্বিধাহীনচিত্তে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বইটি কবির এক গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। সেটি নানালেখায় তিনি অনেকবার জানান দিয়েছেন। কোনো লুকোচুরি নয়। নিজের পরিবর্তনকে ডাকডোল পিঠিয়েই যেনো তিনি বলেছেন। এই তো সাহসী কবির উচ্চারণ। এক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সকল প্রশংসা তাঁর আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাব্যগ্রন্থ। এটা ঈশ্বরের উপদেশে আত্মনিবেদিত কবিতার বই। পুরো বইটি সনেটে। আধ্যাত্মিক আবহে লেখা। ১৯৯৩-৯৪ তে আমি এমন একটা আত্মবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম যে, আমার মধ্যে একটা অন্যরকম বোধ কাজ করছিল। এই বইয়ের প্রতিটি লাইন আমার সেই বাস্তববোধের প্রকাশ। জীবনানন্দ তঁঁর কবিতায় বলেছেন- কবিকে তার কবিতার কাছে সৎ থাকতে হবে। তা হলেই হয়তো একসময় তাঁর কবিতা মহাকালের কবিতার সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়াবে। আমি তাই থেকেছি। এখন আমার মধ্যে যে বোধ এসেছে। তাই আমি কবিতায় উৎসারিত করেছি।” (ভেসেছিলাম ভাঙা ভেলায়, পৃ.১৪৪-৪৫, সূচীপত্র, ঢাকা, ২০০৯।)
এই কাব্যে কবি আল্লাহর প্রশংসা করেছেন মেদহীন-নির্জলা-ঝরঝরে ভাষায়- তিনটি শিরোনামে : সকল প্রশংসা তাঁর, আল্লাহ, জ্যোতির উপরে জ্যোতি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর স্তুতি গেয়েছেন বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পৃথক পৃথক চারটি কবিতায় : হযরত মুহম্মদ (সা:) : আবির্ভাব, হজরত মুহম্মদ (সা.) : মি’রাজ, রাহমাতুল্লিল আ’লামীন, হযরত মুহম্মদ (সা:) : তিরোভাব। খুলাফায়ে রাশেদীনের ইউনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচনা করেছেন ভিন্নভন্ন কবিতা। এছাড়া কয়েকটি কবিতায় আদম, ফেরেশতা, হজরত বেলাল, খালিদ বিন ওয়ালিদ, আবু জার গিফারীসহ অন্যান্য সাহাবার রা. বন্দনাও করেছেন। সেই সাথে আল্লাহর বড় বড় কয়েকটি নিদর্শন যথা : উষা, দিন, মধ্যদিন, তারকা-পুনর্মুদ্রিত রাত্রি নিয়ে কবিতা লিখেছেন।
কবিতাগুলোতে তাঁর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক নান্দনিকতার বলিষ্ঠ বোধ উচ্চকিত হয়েছে। ইসলামপূর্ব আরবের অবস্থা খুবই শোষণীয় ছিল। নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই ছিল না। কোনোশৃঙ্খলা ছিল না। বেহায়াপনায় ডুবে ছিল পুরো জাতি। চক্ষু লজ্জা বলতে কিছুই ছিল না। নারী সন্তানকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যারও নজির পাওয়া যায়। মোটকথা নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা-সভ্যতা, মানবতাবোধ ও ধার্মিকতার কোনো পরিবেশ ছিল না। এমন পরিবেশে নবিজির সা. আগমন “শতাব্দীর প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ড হলো নির্বাপিত” । তাঁর আলো ছড়িয়ে পড়ল ‘সিরিয়ার প্রাসাদমন্ডলী’ পর্যন্ত। নবিজির সা. আগমনে অবহেলিত, নির্যাতিত মানুষ খুশি হলেও খুশি হয়নি ইহুদিসমাজ।
ইয়াসরিবের দুর্গ থেকে জন্মের তারকা আহমদের
ওই দ্যাখো হতবাক হয়ে দেখছে ইহুদিওসমাজ।
পৃথিবীর যুগ-যুগান্তের আশা পূর্ণ হলো আজ।
‘সালাম! সালাম!’ ধ্বনি ছেয়ে গেল সমস্ত জগতে।
[হযরত মুহাম্মদ (সা.) : আবির্ভাব]
মদিনা নবিজিকে সা. পেয়ে প্রত্যাশার প্রাপ্তিতে আনন্দ উল্লাস করে ‘সালাম! সালাম!’ ধ্বনিতে। এই কবিতায় কবি শুধু জন্মের প্রেক্ষাপট কিংবা প্রত্যাশা নিয়েই আলোচনা করেননি, নবিজির সা. জন্মক্ষণ নিয়েও কথা বলেছেন। নবিজির সা. জন্ম নিয়ে প্রায় ১২টিরও বেশি মতামত থাকলেও তিনি আদি জীবনীকারদের উৎসমত এবং আমাদের দেশে প্রচলিত রেওয়াজকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বলে মনে হয়েছে- ‘রবিউল আওয়াল-দ্বাদশ রজনী-সোমবার’। যদিও আধুনিক পঞ্জিকা মতে উক্ত তারিখ সোমবার নয় বলেও জানা যায়।
মেরাজ হচ্ছে, রাসুল সা. এর প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার কুদরতেরই একটি বিশেষ অংশ। নবুওয়াতের ১০টি বছর অসহ্য নির্যাতন, নিপীড়ন-উৎপীড়ন, জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে ঘাত-প্রতিঘাত পারি দিয়ে রাসূলাল্লাহ সা. ইমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। হারিয়েছেন অনেক প্রিয়জন। এর পরেই সান্ত¦না স্বরূপ মহান আল্লাহ তার পিয়ারে হাবিব হজরত মুহাম্মদ সা. কে মেরাজের মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন, যা বিপদকে আনন্দ উল্লাসে এবং অপমানকে সম্মানে রূপান্তরিত করেছেন। অত্যন্ত দ্রæতগামী যান ‘ডানাঅলা বোররাক’ হয়ে তিনি উর্ধকাশে প্রথম থেকে সাত আসমানে ভ্রমন করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন। নবিদের সাথে সাক্ষাৎ, জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্য অবলোকনসহ নানা ঘটনার বর্ণনা উঠে এসেছে হজরত মুহাম্মদ (সা.) : মি’রাজ কবিতায়। অবশেষে পায় চির আকাক্সক্ষার- ‘আল্লার সান্নিধ্যলাভ’। কবির ভাষায়-
প্রথম আকাশ থেকে সপ্তম আকাশ অব্দি চলে
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব নবীদের পাশে থেকে দেখা
জান্নাত ও দোজকের দৃশ্যাবলি। তারপর একা
আল্লার সান্নিধ্যলাভ হলো তাঁরই করুণার বলে।
[হজরত মুহাম্মদ (সা.) : মি’রাজ]
এই ভ্রমণ কোনো অলিক কল্পনা কিংবা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন নয়। এটি দিবালোকের মতই সত্য। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই- দিনের সত্যের চেয়ে সত্যতর যে-নৈশভ্রমণ। এই পৃথিবীই শেষ নয়, আছে পরকাল। যা নবি সা. প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই পরকাল স্বীকারে কবি বলে ওঠেন- এই পৃথিবীর চেয়ে বেশি সত্য পৃথিবীও আছে। রাসূলুল্লাহ সা.-এর রূপ, লাবণ্য, সৌন্দর্য, সৌষ্ঠব ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা বিশেষভাবে উঠেএসেছে রাহমাতুললিল আ’লামিন কবিতায়। দীর্ঘ ও শাদা-রক্তিমাভ দেহ, সুগঠিত কাঁধ, স্মিত হাসি, কালো চুল, নীল চোখ প্রভৃতির বর্ণনা তিনি অতন্ত নিখুঁতভাবে দিয়েছেন। বলেছেন- শরীর তোমার সূর্যালোক বিচ্ছুরিত হয়ে উঠে। এছাড়া তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠতম সাহসী, অতুলনীয় সত্যবাদী, সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, সবচেয়ে অমায়িক ও মিশুক ব্যক্তিত্ব। নি®পাপ চরিত্রেরই প্রতিচ্ছবি এই নিষ্পাপ চেহারা।
শরীর তো শরীর নয়; – সে তো মূলে আত্মার দর্পণ :
তোমার দীর্ঘ বাহু চরাচরে ব্যাপ্ত হয়ে যায়
তোমার নীলিম চোখ হয়ে ওঠে বিশাল গগণ;
চরাচর ছেয়ে যায় অলৌকিক আলোর আভায়।
[রাহমাতুললিল আ’লামিন]
প্রিয় নবি সা. এর চারিত্রিক সৌন্দর্য পৃথিবী ব্যাপ্তি ছড়িয়ে আছে- চরাচর ছেয়ে যায় অলৌকিক আলোর আভায়। সূর্য ও চাঁদের আলোর মত প্রজ্জ্বলিত হয়ে আসছে চোদ্দ শো বছর ধরে। এই আলো নেভানোর বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে কিন্তু সবই বিফলে গেছে। তিনি অম্লান। চির অম্লান। সময়ের সাথে সাথে তিনি আরও প্রাসঙ্গকি হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর মানুষের কাছে- দ্বিতীয় চাঁদের মতো প্রতি রাত্রে হবে বিকশিত।।
প্রিয় নবি সা. এর ইন্তিকালে যে শোকাতুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তারই চিত্র তুলে ধরেছেন হজরত মুহাম্মদ (সা.) : তিরোভাব কবিতায়। শোকাভিভ‚ত গুমোট পরিবেশের কথা তিনি বলেছেন – কাদেনি কে? চরাচর, মৃত্তিকা, আকাশ/ এখন রোদনশীল। কেঁদে ফেরে নক্ষত্র ও ধূলি। তিনি চলে গেলেও তাঁর আনিত আদর্শ চলে যায়নি পৃথিবী থেকে। থাকবে অনন্তকাল।
-চোদ্দ শো বছর পরেকার এই বাংলা কবিতায়
একথা জানাতে চাই : – আজো তাঁর আত্মার বিভায়
পরিব্যাপ্ত এ-পৃথিবী। তিনি এক অজেয় পর্বত।
মানবজাতির জন্য খুলে দিয়েছেন মুক্তিপথ।
কোটি হৃদয়-উদ্যান ভরে গেছে তাঁর ফুলে-ফলে:
জ্ঞান, দয়া, সহিঞ্চুতা ছড়িয়ে পড়েছে ভূমন্ডলে।।
[হজরত মুহাম্মদ (সা.) : তিরোভাব]
সময়ের পরিক্রমায় আজ বাংলা কবিতায় যেমন তাঁর স্তুতি গাওয়া হচ্ছে ঠিক তেমনি অতীতেও হয়েছে। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে। এটাই তাঁর বড় মোজেজা। তাঁর প্রচারিত আদর্শেই রয়েছে মানবজাতির মুক্তি। তাই মানুষ নীড়ে ফিরতে বাধ্য। বিষয় ও শিল্পরীতির দ্বৈত আলিঙ্গনে কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে শিল্পোত্তীর্ণ। কাব্যমহিমা ও কাব্যসুষমায় ভরপুর কবিতাগুলো। ধর্ম, বিশ্বাস, আদর্শ ও এগুলোর অনুগামী বিভিন্ন মিথ ব্যবহার কাব্যগুণকে ম্লান করেনি, সুসংত করেছে। কবিতা শুধু শিল্পই নয়, সমাজে রয়েছে তার প্রভাবও। ‘ঈশ্বরগুপ্তের কাছে কবিতা শুধু শিল্প নয়, সমাজ-সংস্কারের হাতিয়ার’ও বটে, তারই প্রতিফলন যেন সকল প্রশংসা তাঁর কাব্যগ্রন্থটি। নিজের বিশ্বাসকে নান্দনিক উপায়ে ব্যক্ত করে সেই দায়বদ্ধতা পোক্ত করেছেন কবি। কারণ সত্য ও সুন্দরের দিকে কবির অভিসার ছিল প্রতিনিয়ত।