লালদিঘিতে বসবে জব্বারের বলীখেলা !

1

মাহমুদুল হক আনসারী

আবদুল জব্বারের বলীখেলার ১১৬ তম আসর বসবে ঐতিহাসিক লালদিঘি মাঠে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলা ২৫ এপ্রিল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে। এবার জব্বারের বলীখেলার ১১৬ তম আসর বসবে ঐতিহাসিক লালদিঘি মাঠে। বলীখেলা উপলক্ষে ২৪ এপ্রিল থেকে তিন দিনের বৈশাখী মেলা বসবে লালদিঘি মাঠ ও আশপাশের চার বর্গকিলোমিটার এলাকায়।
প্রতিবছর ১২ বৈশাখ ঐতিহ্যবাহী এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বকশিরহাটের আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালে এই বলীখেলার প্রবর্তন করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণ ও যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে কুস্তি বা বলীখেলা শুরু করেছিলেন লালদিঘি মাঠে। সেই থেকে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কালের বিবর্তনে এই বলীখেলা এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। রূপ লাভ করেছে প্রাণের মেলায়।
দেশের আলোচিত জব্বারে বলীখেলা এবং বৈশাখী মেলা সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে ৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠক করেছে মেলা কমিটি। নগর পুলিশের উপকমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে জনসাধারণের নির্বিঘেœ চলাচল এবং যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে আন্দরকিল্লা থেকে আদালত পর্যন্ত প্রধান সড়কে মেলার দোকান না বসানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মেলাকে ঘিরে দোকান বিক্রি, দখল, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকবে বলে জানা যায়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন নগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান মামুন, সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালি) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল করিম, মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও প্রয়াত আব্দুল জব্বার সওদাগরের নাতি শওকত আনোয়ার, বলীখেলার প্রধান রেফারি হাফিজুর রহমান, সাবেক কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন, সাংবাদিক চৌধুরী ফরিদ, মেলা কমিটির সদস্য সংগঠক আলী হাসান প্রমুখ। উল্লেখ্য, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে দুই বছর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই বছর বলীখেলা হয়নি। এ ছাড়া ধারাবাহিকভাবে এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের লালাদিঘির ময়দানে আব্দুল জব্বারের বলী খেলা। বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ এ বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলাকে সামনে রেখে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বিরাজ করে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা গাঁ গ্রামে বলী খেলা গরুর লড়াই , ঘোড়দৌড়সহ বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এসব মেলাতে এ অঞ্চলের মানুষের গৃহস্থালির নানা ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী বিক্রির জন্য আনা হয়। বছরব্যাপী এ পেশার সাথে জড়িত মানুষগুলো নানাজাতের গৃহস্থালির জিনিসপত্র তৈরি করে। দেশব্যাপি লালদিঘির বলি খেলার সাদৃশ্যে লোকসংস্কৃতির মেলা জেলা উপজেলার ও গাঁ গ্রামে তিনদিন চারদিন এক সপ্তাহের ধরে আয়োজনের সংস্কৃতি চালু আছে। সেই লোকসংস্কৃতি ও খেলাসমূহ স্থানীয় জনগণ নানাজাতের ধর্ম গোত্র পেশার মানুষ উপভোগ করে আসছে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশি জনগণ এসব মেলাতে একাকার হয়ে আনন্দের সাথে সংস্কৃতির নানা আয়োজন উপভোগ করে আসছে। বৃহদাকারে চট্টগ্রামের লালদীঘীর আব্দুল জব্বারের এ বলী খেলা।
বলীর রাজ্য হিসেবে পরিচিত ‘চট্টগ্রাম’। জব্বারের বলীখেলা সেই নামেরই প্রমাণ বহন করে চলেছে আজও। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিকে বলী বলা হয়। জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা এ জেলার লালদিঘি ময়দানে প্রতি বছর বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় অংশগ্রহণকারীদেরকে বলা হয় ‘বলী’।
জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। এই প্রতিযোগিতার শুরু ১৯০৯ সালে, যা আজ পর্যন্ত চালু আছে। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘি ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী ও লোকসংস্কৃতি মেলা। মধ্যযুগে সেনাবাহিনীতে যারা চাকরি নিতেন, তাদের শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তারা কুস্তি করতেন। সেখান থেকেই কুস্তি খেলার শুরু। কিন্তু আবদুল জব্বারের বলীখেলার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল? কিভাবে এই প্রতিযোগিতার স্থান করে নিয়েছিল সারা দেশের মানুষের মনে? সেসব ইতিবৃত্ত নিয়ে আজকের লেখা।
১৯০৯ সালে প্রথম এই প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা ‘জব্বারের বলী খেলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদিঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। খেলাটা কিছুটা প্রচলন হওয়ার পর আশপাশের বলীরা সেই সময় মাস দুয়েক আগে এসে লালদিঘি ময়দানে জড়ো হতেন। জব্বার মিয়ার বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেই ঘরেই থাকতেন তারা। সেখানেই তারা খাওয়া-দাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন।
ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের নানা এলাকার বলী বা কুস্তিগীরেরা এই প্রতিযোগিতায় আসতে শুরু করেন। একসময় চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা – নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ নানা জায়গা থেকেও বলীরা আসতো। এরপর সারা দেশ থেকে আসতে শুরু করে কুস্তিবীররা। এমনকি একবার ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করার ইতিহাস আছে। সত্তরের দশক থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশের বলীরা আসতে থাকে। যখন প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচার শুরু হয় তখনই এর সম্পর্কে সবাই আরো ভালোভাবে জানতে পারেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই প্রথম এর সম্প্রচার করেছিলো। এরপর এখন সকল টিভি চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়া ্ও অনলাইন পোর্টাল সম্প্রচার করছে। ফলে গণমাধ্যমের ধারাবাহিক আগ্রহের কারণে জব্বারের বলীখেলা সম্পর্কে আরো প্রচার বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশে ব্যাপক মিডিয়ার প্রচার প্রসার হয়েছে। ফলে আব্দুল জব্বারের বলী খেলা বাংলাদেশ নয় দেশের বাইরেও ব্যাপকভাবে লাইভ সম্প্রচার হয়। জব্বারের বলীখেলা বাংলাদেশি মানুষের যেখানেই যেদেশেই বসবাসরত আছেন, সেখান থেকেই তারা আগ্রহের সাথে খেলা উপভোগ এবং খবরাখবর রাখার অপেক্ষায় থাকে। সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে খেলাটি সুসম্পন্ন হোক স্থানীয় প্রশাসন জনপ্রতিনিধি এবং সংস্কৃতি মনা মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট